News Ticker

Menu

শ্যালক সংশ্লেষ

শ্যালক সংশ্লেষ

বিপুল মজুমদার


অঙ্ক স্যারের কাছে টিউশন পড়ে ফেরার পথে রাস্তায় দুই বন্ধুতে জোর তর্কাতর্কি। দু’জনেই ক্লাস ইলেভ্নের ছাত্র। সমীরের বক্তব্য, প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বয়সে বড়। চন্দনের এতে প্রবল আপত্তি। সে বলছে রাহুল গাঁধী। শেষপর্যন্ত বিতর্কটা বাজির দিকে গড়িয়ে গেল। ঠিক হল, যে হারবে, সে জয়ীকে চারখানা রসগোল্লা খাওয়াবে। বাজির শর্ত চূড়ান্ত হতেই দু’জনে আর সময় নষ্ট করল না। সঙ্গে-সঙ্গে রাস্তার ধারের এক সাইবার ক্যাফেতে ঢুকে পড়ল। সেখানে মালিক লোকটিকে পটিয়ে-পাটিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দু’মিনিটের মধ্যেই জেনে ফেলল, সত্যিটা কী। প্রিয়ঙ্কা নয়, রাহুল গাঁধীই বড়। রাহুলের জন্ম ১৯৭০-এ আর প্রিয়ঙ্কার ’৭২-এ।
বাজি জিতে উল্লসিত চন্দনের যেন আর তর সয় না। সে রসগোল্লা খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করায় সমীর বেশ অস্বস্তিতেই পড়ল। রসগোল্লা খাওয়ানোর মতো যথেষ্ট রেস্ত নেই তার পকেটে। শেষে বন্ধুর জোরাজুরিতে অতিষ্ঠ হয়ে সে বলে উঠল, “কথায় আছে না, লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন? আমারও তেমনই একটা গোপন ব্যাপার আছে, লাগে মিষ্টি, দেবে মোহন সেন! এমন একটা মিষ্টির দোকানে তোকে নিয়ে যাব, যেখানে রসগোল্লা কেন, ইচ্ছে হলে মুফতে তুই যা খুশি খেতে পারবি!”
বন্ধুর কথাটাকে নিছক মজা ভেবে নিয়ে চোখ টিপল চন্দন, “দোকানটা নিশ্চয়ই তোর শ্বশুরের?”
সমীরও চোখ টিপে পালটা ফিচেল হাসি হাসল, “শ্বশুরের নয়, জামাইবাবুর।”
“বলিস কী! পম্পাদি যে ডুবে-ডুবে জল খাচ্ছে, তা তো জানতাম না,” মুখরোচক খবরের সন্ধান পেয়ে রীতিমতো উত্তেজিত চন্দন, “কবে থেকে এসব চলছে রে?”
অনেকদিনের চেপে রাখা গোপন কথা অন্তরঙ্গ বন্ধুকে বলার সুযোগ পেয়ে দ্বিগুণ উত্তেজিত হয়ে উঠল সমীর। ভুরু নাচিয়ে বলল, “আরে ধুর, দিদি কিছুই জানে না!
পুরোটাই একতরফা ব্যাপার। মদনমোহন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিকের ছেলে মোহনদা কিছুদিন হল দিদির প্রেমে পড়েছে, কিন্তু লোকটার দৌড় ওই পর্যন্তই। মুখ ফুটে যে প্রপোজ় করবে, সে হিম্মত নেই। শেষটায় কী মনে হওয়ায় পাকড়াও করেছে আমাকে। তারপর থেকে আমিই মোহনদার ডাকহরকরা!
“মিষ্টির দোকানের সামনে দিয়ে কখনও যেতে দেখলেই হয়েছে, অমনি ডেকে নিয়ে আদর করে ভিতরে বসাচ্ছে আমাকে। তারপর ভরপেট মিষ্টি খাইয়ে একটা খাম গুঁজে দিচ্ছে আমার হাতে।”
“খামের মধ্যে নিশ্চয়ই লাভ লেটার?” চন্দনের দু’চোখে অপার কৌতূহল।
“সে আর বলতে! গত দু’মাসে এভাবে মোট আটখানা লাভ লেটার আমার হাতে দিয়েছে মোহনদা। মিষ্টির দোকানদার হলে কী হবে, দারুণ লেখার হাত মাইরি! প্রত্যেকটা চিঠিই সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে  রাখার মতো।”
চন্দন বিস্মিত, “তুই বলছিস, পম্পাদি কিছুই জানে না। তা হলে খামোকা চিঠিগুলো তুই নিচ্ছিস কেন? আর নিয়ে করছিসটা কী?”
“ধীরে, বত্‌স, ধীরে,” বন্ধুর প্রশ্নের বহরে হেসে ফেলল সমীর, “এমনি-এমনি কি নিচ্ছি আর? প্রথমদিন ভরপেট মিষ্টি খেয়েই বুদ্ধিটা স্পার্ক করেছিল মাথায়। যদ্দিন পারি, এর থেকে ফায়দা তুলে যেতেই হবে। তুই তো জানিস, মিষ্টি খেতে কেমন ভালবাসি আমি! তাই ভাবলাম, দিদির হাতে চিঠি পৌঁছনোর জন্য মোহনদা যে খাতিরটা আমাকে করছে, সেটা দীর্ঘদিন ধরে এনজয় করতে হলে চিঠিগুলো হাপিস করতে হবে আমাকেই। এবার সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট প্রশ্ন হল, লাভ লেটারগুলো নিয়ে আমি কী করছি? স্ট্রেট আমার পড়ার টেব্লের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখছি। যাকে বলে একেবারে কফিনবন্দি করে রাখা, তাই করছি, বস!”
সমীর যে ডাকাবুকো ছেলে তা চন্দন জানে। কিন্তু তাই বলে এতটা! সে চোখ কপালে তুলে বলল, “কিন্তু আটখানা লাভ লেটার লিখে যে-কোনও লোকই তো অধীর হয়ে উঠবে। পম্পাদির কাছ থেকে উত্তরের জন্য মোহনদা তোকে চাপ দিচ্ছে না?”
“দিচ্ছে না আবার? রেগুলারই দিচ্ছে! আমি এই বলে ঠেকিয়ে রেখেছি যে, দিদি এখনও মনস্থির করে উঠতে পারেনি। করতে পারলেই জবাব দেবে।”
ফোকটে মিষ্টি খাওয়ার জন্য এতবড় ঝুঁকি নেওয়া! ধরা পড়লে দু’তরফের কেউই সমীরকে আস্ত রাখবে না। চন্দন তাই ঢোক গিলল, “কিন্তু একটা সময় তো আসবেই, যখন মোহনদা ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে। তখন?”
বন্ধুর উদ্বিগ্ন প্রশ্ন সমীর গায়েই মাখল না। বরং তাকে বেশ অবাক করেই খিকখিক করে হেসে উঠল। কোনওরকমে হাসি সামলে বলল, “তখনকার কথাও ভেবে রেখেছি, দিদির হয়ে নিজে উত্তর দিয়ে যাব। তাতেও বেশ কিছুদিন মিষ্টি খাওয়াটা চালিয়ে যেতে পারব আশা করি। তারপরও যদি সঙ্কটে পড়ি তখন তূণ থেকে শেষ অস্ত্রখানা বের করব। সব কেচ্ছা চুকিয়ে দিতে স্ট্রেটকাট লিখব, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে, মোহন! ভবিষ্যতে চিঠি  লিখে তুমি আর আমাকে বিরক্ত করবে না। বিদায়!”
বন্ধুর আত্মবিশ্বাস দেখে চোখ টেরিয়ে গেল চন্দনের। তবু গলায় সংশয় মিশিয়ে বলল, “বাহ্, তুই চিঠিতে এসব লিখবি আর মোহনদা সেটা চোখ বুজে মেনে নেবে? প্রেম জিনিসটা এত জলভাত, এটা ভাবলি কেমন করে? লোকটা বিগড়ে গেলে কিন্তু কেসটা বাজে দিকে টার্ন করতে পারে।”
“নাহ্, তা হবে বলে মনে হয় না। একনম্বরের কেবলু বলতে যা বোঝায়, মোহনদা হল তাই। ওসব লোককে ম্যানেজ করতে আমার একমিনিটও সময় লাগবে না, তুই দেখে নিস।”

।। ২ ।।
uk
মদনমোহন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল সমীর। পিঠের ব্যাগটাকে ঠিকঠাক করে চাপা গলায় চন্দনকে বলল, “শোকেসের ওপাশে যে ফরসা, হিরোমার্কা লোকটাকে দেখছিস, ওই হল মোহনদা। আমরা এখানে দাঁড়িয়ে একটু গল্প করার ভান করি। দেখতে পেলে কেমন হইচই ফেলে দেবে দেখিস।”
একটু পরেই সমীরের কথাটা ঠিক মিলে গেল। ওদের দিকে চোখ পড়তেই শোকেসের কাচের উপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল মোহনদা, “এই, সমীর, শোনো একবার, তোমার সঙ্গে একটা খুব দরকারি কথা আছে।”
কথাটা যে কী, সমীর তা ভালই জানে। খেজুরে কথাবার্তার ফাঁকফোকরে ন’নম্বর লাভ লেটারটা কায়দা করে সমীরের পকেটে চালান করে দেওয়াই আসল উদ্দেশ্য। সমীর চন্দনকে সঙ্গে নিয়ে শোকেসের উলটোদিকে পৌঁছে গেল। মুখে হাসি
টেনে বলল, “বলুন, মোহনদা, কী বলবেন।”
“এভাবে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কথা হয় নাকি? ভিতরে এসে বোসো, একটু জিরিয়ে নাও, তারপর তো কথা,” কথাটা বলে চন্দনের উপর চোখ পড়তেই ভুরু নাচাল মোহনদা, ‘‘ওকে তো চিনলাম না। কে ও?”
“আমার বন্ধু, মোহনদা। ওর নাম চন্দন। আমরা এক ক্লাসেই পড়ি।”
“তা বেশ তো, বন্ধুকে নিয়ে ভিতরে এসে বোসো না। বহুদিন পর দোকানে আবার নলেন গুড়ের সন্দেশ করেছি। দু’জনে মিলে চেখে দেখে বলো তো কেমন হয়েছে।”
সমীরের মনের মধ্যে আনন্দের চোরা স্রোত বয়ে গেল। এসো বাবা, লাইনে এসো! সে চন্দনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে পাকা অভিনেতার মতো মুখে একটা লাজুক ভাব ফুটিয়ে তুলল, “এই জন্যই এই রাস্তায় আসতে চাই না, মোহনদা। আপনি খাওয়ার জন্য এত জোরাজুরি করেন না…”
শুনে আহ্লাদে যেন গলে পড়ল মোহনদা, “কী বলছ, ভাই, তোমাকে জোরাজুরি করব না তো কাকে করব? তুমি হলে গিয়ে আমার নিজের লোক, আপনজন! আরে এসো, ভিতরে এসো।”

ভিতরে ঢুকে দোকানের টেব্লে দুই বন্ধু গুছিয়ে বসতে না-বসতেই একজন কর্মচারী দু’প্লেট ভর্তি মিষ্টি নিয়ে হাজির। প্লেটে নলেন গুড়ের সন্দেশ তো রয়েছেই, সঙ্গে রয়েছে রসগোল্লা, পান্তুয়া আর কমলাভোগও। মিষ্টি দেখে লোভে জিভ টসটস করলেও মুখখানা ভাবলেশহীন রাখার চেষ্টা করল সমীর। ঠোঁট কামড়ে বলল, “শুধু নলেন গুড়ের সন্দেশ দিলেই তো পারতেন! খামোকা এত কিছুর কী দরকার ছিল?”
মোহনদা হাসল একটু, “তোমাকে
আদর-আপ্যায়ন করার এই বোধ হয় আমার শেষ সুযোগ, সমীর। আগামিকাল থেকে আমি আর এই মিষ্টির দোকানে বসছি না। বাবা আমাদের দুই ভাইকে ব্যবসা ভাগ করে দিয়েছেন। ভাইয়ের ভাগে পড়েছে এই দোকানটা। আমি বসব আমাদের কলোনি মোড়ের মোবাইলের দোকানটায়।”
সবে নলেন গুড়ের একটা সন্দেশ মুখে পুরেছে সমীর, আর-একটু হলে সেটা গলায় আটকে যেত। জল খেয়ে স্বাভাবিক হয়ে সমীর জানতে চাইল, “কোন মোবাইলের দোকানটা বলুন তো?”
“ওই তো বিবেকানন্দের স্ট্যাচুর উলটোদিকে বড় মোবাইলের দোকানটা, ওখানেই বসব কাল থেকে।”
মিষ্টি খাওয়ার ভবিষ্যত্‌ অন্ধকার বুঝে মোহনদাকে লুকিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সমীর। মুখটাকে আমসি করে বলল, “আপনার এই মিষ্টির দোকানের সেল কিন্তু ভালই ছিল, মোহনদা। ওই মোবাইলের দোকানে শিফ্ট করে বোধ হয় ভুল করলেন।”
মোহনদা থতমত খেয়ে গেল। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলল, “মোবাইলের দোকানটা কিন্তু ভালই চলে, সমীর। আসল কথাটা কী জানো, বাবার ইচ্ছে, বছরদুয়েকের মধ্যে আমার বিয়ে দেবেন। বিয়ের বাজাকে ছেলের যাতে দর বাড়ে, সেই জন্য এসব কাণ্ডকারখানা।”
মিষ্টির দোকান থেকে মোহনদার সরে যাওয়া মানে সমীরের হাতে হ্যারিকেন! ব্যাপারটা মালুম হওয়ায় চন্দন বেশ মুখ টিপে হাসছিল। বন্ধুকে হাসতে দেখে সমীরের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। শুকনো হেসে মোহনদাকে বলল, “ভবিষ্যতে কখনও যদি মোবাইল কিনি, আপনার দোকান থেকেই কিনব, মোহনদা। তখন বেশি-বেশি করে রিবেট দেবেন তো?”
“রিবেট কী বলছ, তোমাকে আস্ত একটা মোবাইলই গিফ্ট করব,” কথাটা বলেই চন্দনকে আড়াল করে পকেট থেকে একটা সাদা খাম বের করল মোহনদা। খামটা চুপিসারে চন্দনের হাতে চালান করে দিয়ে নিচু গলায় বলল, “পম্পাকে বোলো এবার যেন ডিসিশন নেয়। আর যেন না ঝোলায়।”
মিষ্টির দোকান ছেড়ে বাইরে এসে চোখদু’টোকে বড়-বড় করে ফেলল চন্দন। সমীরের মুষড়ে পড়া মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “দিল আছে বটে তোর মোহনদার। একটুতেই কেমন মোবাইল গিফ্ট করার কথা বলে দিল! আমি বলি কী, আর কায়দা না মেরে এবার পম্পাদির হাতে মোহনদার চিঠিগুলো তুলে দে। এমন জামাইবাবু পাওয়া কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার।”
ukzz
সমীরের মুখ তবু পানসে, “ধুর, কোথায় মিষ্টি, আর কোথায় মোবাইল! বারবার তো মোবাইল নেওয়া যাবে না। চিঠিগুলো হল আমার তুরুপের তাস। সেগুলো এখনই দিদির হাতে তুলে দিয়ে মরি আর কী! দু’জনে চেনাজানা হয়ে গেলে মোবাইলের কথাটা যে মোহনদার মাথা থেকে ফুড়ুত্‌ হয়ে যাবে না, সেটা কে বলতে পারে!”
বন্ধুর কথায় আঁতকে উঠল চন্দন, “তার মানে মোবাইল গিফ্ট না পাওয়া পর্যন্ত তুই এমনভাবে চালিয়ে যাবি?”
“সে আর বলতে! আমার দিদিকে তুই চিনিস না। আমার চেয়ে চারবছরের বড় হলে কী হবে, উঠতে-বসতে সর্বক্ষণ আমায় শাসন করছে। দু’জনের প্রেমটা হয়ে গেলে  ও-ই হয়তো মোহনদাকে বলে দেবে, ওইটুকু ছেলেকে এখনই মোবাইল দেওয়ার কোনও দরকার নেই। আগে কলেজে উঠুক, তারপর দিয়ো। তাই আগে মোবাইল পাই, তারপর চিঠি দেওয়ার প্রশ্ন।”

।। ৩ ।।
শাহরুখ খানের নতুন সিনেমা। চারটে সাতটার শো। হলের সামনে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা মাছির মতো ভনভন করছে। ফিজ়িক্স স্যারের কোচিং ক্লাস কেটে সমীর আর চন্দনও এসে হাজির হয়েছে সিনেমা হলে। দুই বন্ধুই শাহরুখ খানের ডাই হার্ড ফ্যান। অনেক ঠেলাঠেলি করে ব্যালকনির দু’খানা টিকিট কাটতে পেরে রীতিমতো উল্লসিত দু’জনে। হঠাত্‌ চন্দনের কী হল কে জানে, হলে ঢুকে সিটে বসতে না-বসতেই কিছু একটা দেখে সহসা রুমাল দিয়ে মুখটাকে ঢেকে ফেলল। ভয়ার্ত গলায় বলল, “সমীর রে, তুই এবার গেলি বোধ হয়। আমাদের দশ-বারোটা রো নীচে ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে পম্পাদি বসে আছে!”
বন্ধুর কথাটা কানে যেতেই সমীরের বডি ল্যাঙ্গওয়েজ বদলে গেল। চকিতে পাশের দর্শকের কাঁধের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে-করতে বলল, “যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়! বহুত ঝামেলা হল দেখছি, দেখতে পেলে দিদি কথাটা বাবা-মাকে ঠিক লাগিয়ে দেবে।”
চন্দন হিসহিস করে উঠল, “বাঁচতে চাইলে রুমাল দিয়ে মুখটাকে ঢেকে ফ্যাল।”
সমীর অবশ্য সে পথে গেল না। ঝটিতি গলা থেকে মাফলারটা খুলে নিয়ে নাক-মুখ, মাথা পেঁচিয়ে এমনভাবে বাঁধল, যাতে তাকে চেনা না যায়। আশপাশের অনেকেই ড্যাবডেবিয়ে ওর কাণ্ডকারখানা দেখছে তখন। সেসবের তোয়াক্কা না করে সে ফিসফিস করে চন্দনকে বলে উঠল, “তোর কী মনে হয়, দিদি আমাকে দেখছে?”
চন্দন কাঁধ ঝাঁকাল, “মনে হয় দ্যাখেনি। পাশের সিটের লোকটার সঙ্গে গল্পে এমন বুঁদ হয়ে আছে যে, এদিকে তাকানোর ফুরসতই বা কোথায়!”
চন্দনের কথার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত
লুকিয়ে আছে জেনেও সমীর কোনও তর্কে গেল না। উদ্বিগ্নভাবে বলল, “লোকটা দেখতে কেমন রে?”
খানিক উঁকিঝুঁকি মেরে মাথা নাড়ল চন্দন, “না, পিছন থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কিছু মনে করিস না, পম্পাদি কি কারও সঙ্গে প্রেম-ট্রেম করে?”
সমীর থমকে গেল। মাফলারের আড়ালে থাকা চোখদু’টো পিটপিট করে বলল, “আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে কলেজের কয়েকজনের সঙ্গে ওর হেভি দোস্তি আছে। আচ্ছা, বাঁ কানে দুল আছে কি না, দ্যাখ তো? দুল থাকলে ওটা তাপসদা হবে।”
বন্ধুর কথায় মুখের রুমাল সরিয়ে উঁকি মারল চন্দন। একনজর দেখেই বলল, “নাহ্, কোনও দুল-টুল নেই।”
“তা হলে দ্যাখ তো, চুল লালচে কি না? লালচে হলে পুষ্করদা হতে পারে।”
“নাহ্, চুল পুরোপুরি কুচকুচে কালো।”
চন্দনের কথা ফুরোতেই হল অন্ধকার হয়ে শো শুরু হয়ে গেল। এরপর ইন্টারভ্যাল হতেই চন্দন বলল, “তুই মাফলার জড়িয়ে চুপচাপ বসে থাক, সমীর। আমি কাছে গিয়ে টুক করে একবার দেখে আসি, পম্পাদির পাশের লোকটা কে।”
মিনিটখানেক চক্কর কেটে ফিরে এল চন্দন। চেয়ারে বসেই উত্তেজিতভাবে বলে উঠল, “এ কী অদ্ভুত কাণ্ড! তোর দিদির পাশে মোহনদা বসে আছে রে!”
“মোহনদা? কী ফালতু বকছিস!” মাফলারের আড়ালে থাকা সমীরের চোখ দু’টো ঠিকরে বেড়িয়ে এল, “তুই ঠিক দেখেছিস?”
“ঠিক মানে? একেবারে হান্ড্রেড পারসেন্ট ঠিক! সেদিন মিষ্টির দোকানে মোহনদা লোকটাকে এতবার দেখেছি যে, ভুল হওয়ার কোনও চান্স নেই।”
মোহনদার সঙ্গে দিদির যোগাযোগটা কি ভূতে করিয়ে দিল! সমীর ভেবে কোনও কূলকিনারাই পেল না। তা হলে কি এমন হয়েছে, ভাবী শ্যালকের হাতে ন’নম্বর চিঠিটা গুঁজ়ে দেওয়ার পরও কোনও সুরাহা না হওয়ায় একরকম মরিয়া হয়েই দিদির সঙ্গে কথা বলেছে মোহনদা? আর তাতেই দুধ জমে ক্ষীর? তাই যদি হয়, তা হলে সমীরের সমস্ত ফন্দিফিকিরই ফাঁস হয়ে গিয়েছে দিদির কাছে। ব্যাপারটা মাথায় খেলতেই আরও কুঁকড়ে গেল সে। তেতো পাঁচন গেলার মতো মুখ করে বলল, “হে ভগবান!”
শো ভাঙলে দিদিকে এড়ানোর জন্য শর্টকাট রাস্তা ছেড়ে ঘুরপথটাই বেছে নিল সমীর। চন্দন অন্য পাড়ায় থাকে। বাড়ি ফেরার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগিয়েছে সে। সমীর একা-একাই হাঁটছিল। চওড়া রাস্তাটা ছেড়ে গলির মুখে এসে পড়তেই পিছন থেকে একজনের চিকন গলা শুনতে পেল। গলাটা শুনেই বুকটা ধড়াস করে উঠল সমীরের। দিদি চিত্‌কার করে বলছে, “অ্যাই, ভাই, দাঁড়া… দাঁড়া বলছি।”
শুনশান গলি। লোকের ভিড়ে মিশে গিয়ে গা ঢাকা দেবে সে উপায় নেই। অগত্যা ল্যাম্পপোস্ট হয়ে দাঁড়িয়েই পড়ল সমীর। কাছে এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে পম্পা বলল, “কী রে, সিনেমাটা কেমন লাগল?”
“কোন সিনেমা? কীসের সিনেমা?” আকাশ থেকে পড়ার ভান করল সমীর।
ঠোঁট টিপে হাসল পম্পা, “ন্যাকামি করিস না। তুই ডালে-ডালে চললে আমি চলি পাতায়-পাতায়। তুই কি ভেবেছিস, আমি তোকে দেখতে পাইনি? মাফলার জড়িয়ে যতই সং সাজার চেষ্টা করিস না কেন, চেক শার্টটার জন্য ঠিক ধরা পড়ে গিয়েছিস।”
সমীর দ্রুত ভেবে নিল। কথায় আছে, আক্রমণই আত্মরক্ষার সেরা পথ। সে নিজের দিদির চোখে-চোখ রেখে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, “আমার চোখেও কিন্তু ধরা পড়ে গিয়েছিস তুই। মোহনদার সঙ্গে তো দিব্যি তো পাশাপাশি বসে সিনেমা দেখছিলি। তা এভাবে ডুবে-ডুবে জল খাওয়া কদ্দিন চলছে?”
সমীরের কথায় পম্পার মেজাজ হঠাত্‌ চটকে গেল। গলায় ঝাঁঝ তুলে বলল, “ডুবে-ডুবে জলটা তো খাচ্ছিলি তুই! ওর লেখা চিঠিগুলো একের পর-এক টেব্লের ড্রয়ারে চালান করে দিয়ে ভেবেছিলি, আমি কিছুই টের পাব না। কিন্তু কপালে প্রেম থাকলে ঠেকাবে কে! একদিন টেব্ল গোছাতে গিয়ে চিঠিগুলো হঠাত্‌ আবিষ্কার করলাম। একটা নয়, দু’টো নয়, একসঙ্গে ছ’-ছ’খানা চিঠি। উত্তর পাচ্ছে না, তবুও চিঠি লিখে যাচ্ছে বেচারা। সহানুভূতিতে মনটা গলে গেল। অনেক ভেবে শেষটায় নিজে থেকেই যোগাযোগ করলাম মোহনের সঙ্গে।”
“ছ’খানা চিঠি… তার মানে মানে তোরা আগে থাকতেই…” কিছু বুঝতে না পেরে সমীর তাকাল।
“হ্যাঁ, মোহন ছ’নম্বর চিঠিটা লেখার পরই আমি সব জেনে ফেলি।”
সমীর হতভম্ব, “তা হলে তারপরও কেন মোহনদা আরও তিনখানা চিঠি দিল আমাকে?”
“তোর সঙ্গে মজা করছিল। আমি বারণ করলেও শোনেনি। বলেছিল, ‘শালা-ভগ্নিপতির সম্পর্ক যখন, তখন খেলাটা চলতে থাকুক। দেখি না, কোথায় গিয়ে থামে ও।’”
সব কথা শুনে লজ্জায় নুয়ে পড়ল সমীর। শ্লথ পায়ে হাঁটতে-হাঁটতে বলল, “আচ্ছা ঘোল খাওয়াল বটে মোহনদা। মানুষটা যে এত চালাক, কে জানত!”
ভাইয়ের কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠল পম্পা। হাসি থামিয়ে বলল, “তুই নাকি ওর কাছ থেকে মোবাইল কিনবি বলেছিস?”
সমীর ঘাবড়ে গেল। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে-করতে বলল, “হ্যাঁ, বলেছিলাম তো… মোহনদা তো বলছিল আর মিষ্টির দোকানে বসবে না, মোবাইলের দোকানে বসবে। সেই জন্য ভেবেছিলাম… আসলে… ইয়ে মানে…”
পম্পা উত্তরে বলল, “ও বলেছিল, তোকে একটা মোবাইল গিফ্ট করবে। কিন্তু আমিই বারণ করে দিয়েছি। বলেছি, ভাই আগে কলেজে উঠুক, তারপর দিয়ো।”
“তুই না একটা যা তা,” রেগে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল সমীর, “কলেজে উঠতে তো এখনও দেড়-দু’বছর দেরি আছে।”
“হোক না দেরি। এখন মোবাইল পেলে বাবার জেরার মুখে পড়তে হবে। তখন কী বলবি বাবাকে? মোহন বলেছে, দেড়-দু’বছরের মধ্যে বিয়েটা সেরে ফেলবে। তারপর মোবাইল দিলে তো কারও কিছু বলার থাকবে না।”
সমীর থ। নদী দিয়ে জল যে অনেকদূর গড়িয়ে গিয়েছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। এখন দর্শক ছাড়া আর কোনও ভূমিকায় মানাবে না তাকে। তবু মুখটাকে পানসে করে সে বলল, “এতদূর পর্যন্ত তোরা ভেবে ফেলেছিস? পারিসও বটে!”
পম্পার ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি। চোখ টিপে বলল, “তবে মোবাইল তোকে ও দেবেই। আজ সিনেমা হলে ঢোকার
আগেই বলছিল, ‘সমীর ঘোঁট না পাকালে তোমাকে আমি পেতাম কিনা সন্দেহ। এতগুলো চিঠি একসঙ্গে দেখেছিলে বলেই না তোমার মন গলেছিল। ওর হাতযশেই যেহেতু আমাদের প্রেম দানা বেঁধেছে, সেইজন্য ওকে শ্যালক পুঁটুলি
না দেওয়াটা মহা অন্যায় হবে। আজ হোক, কাল হোক, মোবাইল আমি ওকে দেবই।’”
দিদির কথা শুনে চুপ করে গেল সমীর।
শুনশান রাস্তায় ক’দিন আগে বলা
চন্দনের একটা কথা ওর কানে এসে যেন আছড়ে পড়ল, এরকম জামাইবাবু পাওয়া কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার। বাতাসে ঠান্ডার আমেজ। নির্জন রাস্তায় দুলকি
চালে হাঁটতে-হাঁটতে নীরবে হেসে উঠল সমীর। অন্ধকার বলে ওর হাসিটা পম্পা দেখতে পেল না।

Share This:

Post Tags:

Jyoti Sing

I'm Jyoti Sing. A full time web designer. I enjoy to make modern template. I love create blogger template and write about web design, blogger. Now I'm working with Themeforest. You can buy our templates from Themeforest.

  • To add an Emoticons Show Icons
  • To add code Use [pre]code here[/pre]
  • To add an Image Use [img]IMAGE-URL-HERE[/img]
  • To add Youtube video just paste a video link like http://www.youtube.com/watch?v=0x_gnfpL3RM