রিকিসুমের ইয়ং হাজ়ব্যান্ড
রিকিসুমের ইয়ং হাজ়ব্যান্ড
সঞ্জীব চৌধুরী
রাস্তা আর সাহস, দুটোই সূর্যাস্তের সঙ্গে-সঙ্গে অনেকক্ষণ আগেই হারিয়ে ফেলেছি। পাহাড়ে রাস্তা হারালে রাতের অন্ধকার যেমন লাগে, চারপাশ তেমনই ভয়ঙ্কর। গাড়ির দুর্বল হেডলাইটের আলো জমাট কুয়াশার গায়ে সমানে ধাক্কা খেতে-খেতে বিপদকে যেন ডেকে আনছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মনে হচ্ছে গাড়ির উইন্ডশিল্ড ফাটিয়ে ভিতরে ঢুকে আসবে। সূর্য আর আমি প্রায় এক ঘণ্টা হল কেউ কারও সঙ্গে একটা কথাও বলিনি, বলার মতো কিছু নেইও। কোথায় যাচ্ছি, সামনে কী আছে কিছুই জানি না। ও গাড়িটা চালিয়ে যাচ্ছে, আর আমি চোখ খোলা রেখে চারপাশ দেখে যাচ্ছি।
খুব সাবধানে পাহাড়ের গা ঘেঁষে একটা হেয়ার-পিন বাঁক কোনওরকমে পেরিয়ে অনেকটা উপরে উঠতেই আমার বাঁ দিকের অন্ধকারের ভিতর থেকে একটা কাঁপা-কাঁপা ক্ষীণ আলোর রশ্মি দেখতে পেলাম। আলোটা সূর্যও লক্ষ করেছে, কিন্তু সেটা যে ঠিক কোথায়, কত দূরে, কিছুই ঠাহর হচ্ছে না। সূর্যকে বললাম, “আমি যাচ্ছি। এঞ্জিনটা চালু রাখ আর হেড লাইটটা জ্বেলে রাখিস কিন্তু, নইলে ফিরতে পারব না।”
যা থাকে কপালে এই ভেবে ওভারকোটের কলারটা তুলে গাড়ির দরজাটা খুলেই আলোটা লক্ষ করে ছুটলাম। এইটুকু আসতেই ওভারকোটটা ভিজে জবজবে হয়ে গেল। সারা শরীর ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে আসছে। আমার সামনে একটা ছোট্ট পাথরের ঘর। দরজাটা বন্ধ। জানলা বলতে পাথরে গাঁথা একটা কাচ। তারই ভিতর থেকে আলোটা আসছে। কাচের গায়ে জমে থাকা কুয়াশাটা আঙুল দিয়ে মুছে দেখলাম, এক বৃদ্ধ লেপচা ঘরের ভিতরে একটা চৌকির উপর হাঁটু মুড়ে বসে আছেন। পায়ের নীচে একটা কাঠের আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। ঘর ভরতি ধোঁয়া। টুপির নীচে বৃদ্ধের চোখ দু’টো খোলা, নাকি উনি বসে-বসে ঘুমোচ্ছেন, বোঝা যাচ্ছে না। খুব আস্তে জানলায় কয়েকটা টোকা মারতেই বৃদ্ধ মাথাটা অল্প তুলে তাকালেন। আমি হিন্দিতে চেঁচিয়ে বললাম, “দয়া করে দরজাটা খুলবেন? রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি।”
বৃদ্ধ আমার কথা শুনতে পেলেন কি না, বোঝা গেল না। অনুমতির জন্য সময় নষ্ট না করে দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। আমি ভিজে জুতো পরেই ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়ালাম। বৃদ্ধ একটুও বিচলিত হলেন না। কাঠের আগুনের আলোটা ডান হাত দিয়ে আড়াল করে আমাকে একবার দেখে নিয়ে আগুনের পাশে মাটিতে পাতা কম্বলটা দেখিয়ে বসতে বললেন। এই মুহূর্তে ভদ্রতা অর্থহীন। বাঁচার জন্য দরকার রাতের আশ্রয় আর একটু আগুনের উষ্ণতা। বাইরে জোরালো বিদ্যুতের সঙ্গে একটা বিশাল বাজ পড়ল। আমি যত জোর সম্ভব চিত্কার করে সূর্যকে ডাকলাম, “সূর্য, গাড়িটা বন্ধ করে দৌড়ে চলে আয়, এখানে আগুন আছে।”
কালিম্পংয়ে গোম্পুস রেস্তরাঁতে দুপুরে লাঞ্চের পর একটানা গাড়িটা চালিয়ে আসছে। ভেবেছিলাম মাইল তিরিশেক রাস্তা, বিকেলের মধ্যেই পৌঁছে যাব। এমন দুর্যোগে যে পড়তে হবে, কে জানত? ওর গায়ে শুধু একটা ফুলস্লিভ সোয়েটার। টুপিটাও সুটকেসের ভিতরে। আর সুটকেসটা ডিকিতে। সম্পূর্ণ ভিজে ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়াতেই বৃদ্ধ নিজের গায়ের কম্বলখানা খুলে সূর্যর দিকে এগিয়ে দিলেন। এ অভাবনীয় আতিথেয়তায় আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
বৃদ্ধ হিন্দি বোঝেন কি না, জানি না। তবু হিন্দিতেই বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে, আমরা কলকাতা থেকে কালিম্পং হয়ে গাড়ি চালিয়ে আসছি, রিকিসুম বলে এদিকের একটা গ্রামের খোঁজে। অন্ধকারে, বৃষ্টিতে পথ হারিয়ে ফেলেছি। আজকের রাতের মতো যদি ওঁর ঘরে একটু আশ্রয় দেন, কাল সকাল হলেই বেরিয়ে যাব।
বৃদ্ধ ঘরের কোণে রাখা একটা বিশেষ পাত্রের দিকে ইঙ্গিত করলেন। বুঝলাম ওতে টোংবা আছে। টোংবা লেপচাদের পানীয়, আমরা কালিম্পংয়ে টেস্ট করেছি। দু’পাত্র টোংবা দু’জনে গলায় ঢেলে নিয়ে কম্বলের উপর বসতেই বৃদ্ধ আমাদের চমকে দিয়ে পরিষ্কার ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, “রিকিসুমের খবর তোমাদের কে দিল? তোমাদের সেখানে কাজটাই বা কী?”
ভাষার ব্যাপারটা যে এত সহজে মিটে যাবে আশাই করিনি। মুহূর্তে সব অস্বস্তি কেটে গেল। সূর্য ওঁকে আমাদের রিকিসুমের উদ্দেশ্যটা খুলে বলল।
রিকিসুমের ভুটান-তিব্বত সীমান্তের এক প্রত্যন্ত ভারতীয় গ্রাম। এই গ্রামের গা ঘেঁষেই চলে গিয়েছে ঐতিহাসিক সিল্ক রুট। এক সময় চিন তিব্বতের ব্যবসায়ীরা দলে-দলে খচ্চরের পিঠে পসরা চাপিয়ে জেলেপ-লা পাস হয়ে এই পথ দিয়ে ভারতে আসা যাওয়া করত। ভারতের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এই পথেই পাড়ি দিতেন দূর দেশে বুদ্ধের বাণী প্রচারের জন্য। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অনেক ব্রিটিশ এক্সপ্লোরার এই রিকিসুমেই রাত কাটিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে চলে যেত ভারতের বাইরে ভুটান, তিব্বত পেরিয়ে আরও দূরে। ইংরেজ ও ফরাসি ধর্মপ্রচারকরাও এই রিকিসুম থেকেই ছোট-ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষা, পায়ে চলা পথে তিব্বত ও চীনের দিকে চলে যেতেন সাধারণ পাহাড়ি মানুষদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে। এঁদের বলা হত ইভাঞ্জেলিস্ট। কোনও অজ্ঞাত কারণে বহু ইভাঞ্জেলিস্ট রিকিসুম থেকে তিব্বতের দিকে চলে যাওয়ার পর আর কোনওদিন ফিরে আসেননি। এই সব নিখোঁজ ইভাঞ্জেলিস্টদের জন্য ১৯০২ সালে ফাদার অগাস্তিন দেসগদিন্স নামে এক ফরাসি পাদ্রি, এই রিকিসুমের কাছেই একটা পাহাড়ের মাথায় কাঠের তৈরি এক বিশাল ক্রস স্থাপন করেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, কোনও একদিন ওই সব হারিয়ে যাওয়া ইভাঞ্জেলিস্টরা নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন। তখন পাহাড়ের মাথায় বসানো এই ক্রসটি ওঁদের রিকিসুমের পথ চিনে নিতে সাহায্য করবে। এই ক্রস আজও আছে, আর ওই পাহাড়টার নামই হয়ে গিয়েছে ক্রস হিল।
সূর্য শুধু ইতিহাসের ভাল ছাত্র বললে ভুল হবে, ইতিহাসে ওকে সব সময় পিছনে টানে। পুজোর সময় ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটের একটা পুরনো রেকর্ডের দোকানে ও আর আমি এলপি রেকর্ড ঘাঁটছি। লক্ষই করিনি যে, পাশে একটা পুরনো ম্যাগাজ়িন পড়ে আছে। কভার পেজে রিকিসুমের নামটা দেখেই সূর্য আমায় ডেকে দেখাল। বইটা আমাদের সঙ্গেই আছে, গাড়ির ডিকিতে। স্টোরিটার প্রথমেই হাফ পাতা জুড়ে এক লেপচা গ্রামের ছবি, তারপর দেড় পাতা রিকিসুমের ইতিহাস আর শেষের পাতায় পাহাড়ের মাথায় একটা বাংলোর ধ্বংসাবশেষের প্যানোরামিক ছবি। বাংলোর সামনে পাথরের উপরে বসে এক স্থানীয় লেপচা পাইপ খাচ্ছে। পায়ের কাছে একটা পাহাড়ি কুকুর। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ছবিটা অসাধারণ। ওই বাংলোটা উনিশ শতকের গোড়ায় ব্রিটিশ এক্সপ্লোরারদের চিন-তিব্বত এক্সপিডিশনে যাওয়ার পথে রাত কাটানোর জন্য রিকিসুমে তৈরি করা হয়েছিল।
ব্যস, সেই থেকে রিকিসুম সূর্যর মাথায় গেঁথে রয়েছে। ও গত তিনমাস ধরে ওই ব্রিটিশ বাংলোটার স্বপ্ন দেখে আসছে। আমার লাইকাটা সূর্যর এরকম খেয়ালের জন্যই মাঝে-মাঝে ব্যবহার হয়, নইলে পড়ে-পড়ে কবেই লেন্সে ফাংগাস জমে যেত।
সূর্যের মুখে ব্রিটিশ এক্সপ্লোরার্স বাংলোটার কথা শুনে বৃদ্ধের ঠোঁটে হালকা একটা হাসি লক্ষ করলাম। মনে হল ওঁর অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। বৃদ্ধের মুখের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ। পোর্ট্রেট ফোটোগ্রাফির জন্য আদর্শ। কাঠের আগুনের আলোয় বেশ লাগছে।
আমার ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা। আজ ১৯৬৯-এর শেষ রাত। কাল ভোরে নতুন বছরের সূর্য উঠবে। সারা দিনের ক্লান্তির পর এই নিশ্চিন্ত, উষ্ণ আশ্রয়ে শরীরটা ছেড়ে দিল। গায়ের ভিজে কোটটা দেওয়ালের পেরেকে ঝুলিয়ে মাটিতে পাতা কম্বলের উপরে শুয়ে পড়লাম। বৃদ্ধ আগুনের কাঠটা উসকে দিয়ে চৌকির উপর গা এলিয়ে দিলেন। সূর্য এর মধ্যেই দেওয়ালে পিঠ দিয়ে আধশোয়া হয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করছে। ওর সবরকম অভ্যেস আছে।
চোখের উপরে রোদ পড়তেই ঘুমটা ভেঙে গেল। বৃদ্ধকে ঘরে দেখলাম না। সূর্যকে ডাকতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। বাইরের ঝলমলে রোদ উঠেছে দেখে মনটা আনন্দে ভরে গেল। আজ নিউইয়ার। ঘরে বাইরে এসে বুঝলাম, আমরা যে পাথরের ঘরটায় আছি সেটা একটা পাহাড়ের ঢালের একেবারে শেষ সীমায়। সামনে গভীর খাদ। চারপাশে নানা রকমের পাহাড়ি গাছের ঝোপ। এছাড়া কিছু সিডার, পাইন আর চেস্টনাট ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে। পাথরের ঘরটায় পিছন থেকে পাহাড়টা ধাপে-ধাপে উপরে উঠে গিয়েছে।
খানিকটা উপরেই একটা সুন্দর দোতলা বাংলো। ইংলিশ প্যাটার্নের, কাঠের তৈরি। বারান্দাটায় সুন্দর রোদ পড়েছে। এখান থেকে উপরে যাওয়ার জন্য পাথরের উপর পাথর ফেলে সিঁড়ির মতো করা আছে। বিবর্ণ কাঠ আর ভাঙাচোরা অবস্থা দেখলে বাংলোর বয়সটা আন্দাজ করা যায়। খুব কম হলেও পঞ্চাশের কম তো নয়ই। জানলা দরজাগুলো সব বন্ধ, ভিতরে কেউ থাকে বলে মনে হল না।
সূর্যর সব ব্যাপারেই উত্সাহের মাত্রাটা একটু বেশি। আমি কিছু বলার আগেই ও বৃদ্ধের বাড়িটার পিছনের জঙ্গলে ঢুকে গেল। এরকম সময়ে বাধা দিলে ও রেগে যায়। তাই কিছু বললাম না। ভাবছি গাড়ির ডিকি থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে আসব কি না, এমন সময় ওর ডাকে আমাকেও পিছনের জঙ্গলে যেতে হল। এদিকটায় জঙ্গল বেশ ঘন। কোনওরকমে দু’হাতে ডালপালা সরিয়ে ওর পাশে দাঁড়াতেই ও ইশারায় পাহাড়ের মাথাটা দেখাল। দেখি আমাদের মাথার উপরের বাংলোটা থেকে আরও দু’-আড়াইশ ফুট উপরে এক্কেবারে পাহাড়ের ঠিক মাথায় আর-একটা বাংলো। অবিকল একরকম দেখতে। যেন যমজ ভাই। সেটারও অবস্থা জরাজীর্ণ আর জানলা-দরজাও বন্ধ। বাংলোটার মাথায় অনেক গাছ গজিয়ে উঠেছে।
বিস্ময়টা একটু কাটতেই দেখি বৃদ্ধ আমাদের সামনে একটা ঝোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে। এত ঠাণ্ডাতেও গায়ে সামান্যই গরম জামা। মাথায় টুপি। চোখে পুরু ঘষা কাচের চশমা। হাতে কয়েকটা সবুজ পাতা। মনে হয় ওই পাতা তুলতেই বেরিয়েছেন। সূর্য ফিসফিস করে বলল, “তোর ছবির দারুণ সাবজেক্ট, মিস করিস না।”
আমরা “গুড মর্নিং” বলায় বৃদ্ধ হাতের পাতাগুলো দেখিয়ে বললেন, “গুড মর্নিং। কাম, আই শ্যাল মেক সাম মালবেরি টি ফর ইউ।”
আমাদের মনে পড়ে গেল, ম্যাগাজ়িনে লেখা আছে যে, রিকিসুমের মালবেরি পাতা একসময় রেশম চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল এবং চিনাদের কাছে মালবেরি চায়ের খুব কদর। আমরা বৃদ্ধের পিছন-পিছন ঘরে ফিরে এলাম। একটা তামার কেটলিতে পাতাগুলো ফুটিয়ে বৃদ্ধ আমাদের যা দিলেন, তা আর যা-ই হোক না কেন, চা বলে মেনে নিতে বেশ কষ্ট হল। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলাম না। সূর্য দেখলাম অম্লানবদনে পর-পর দু’কাপ চা খেয়ে নিল। ও এসব পারে!
চায়ের পর সূর্য বৃদ্ধকে রিকিসুমের রাস্তাটা বুঝিয়ে দিতে অনুরোধ করায়, ওঁর চোখে-মুখে আবার সেই কাল রাতের চাপা হাসিটা লক্ষ করলাম। কাপের চা শেষ করে হেসে বললেন, “ইউ আর লাকি! কাল রাতে তোমরা রিকিসুমেই এসে পৌঁছেছ আর ওই ব্রিটিশ বাংলোটা এই পাহাড়ের পিছনেই। যদি চাও, আমি তোমাদের দেখিয়ে নিয়ে আসতে পারি।”
আমি আর সূর্য আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। আমাদের খুশিতে বৃদ্ধের চোখে-মুখে যে কী আনন্দ ফুটে উঠল, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। মনে হল বৃদ্ধ যেন আমাদেরই সমবয়সি বন্ধু। সূর্য ওঁকে, ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ উইশ করে একরকম কোলে করেই এক পাক ঘুরিয়ে মাটিতে নামিয়ে দিল। আমি সঙ্গে-সঙ্গে ছুটলাম গাড়ি থেকে ক্যামেরার ব্যাগটা আনতে। এমন একটা দারুণ সকালকে ক্যামেরায় যতটুকু ধরে রাখা যায়!
এতক্ষণে আমরা আমাদের নতুন বন্ধুর পরিচয়টা জেনে নিয়েছি। টি ওয়াই লেপচা। তাসো ইয়ংহাজ়ব্যান্ড লেপচা। উনি বললেন, “কল মি তাসো।”
নামের মাঝের অদ্ভুত শব্দটা শুনে সূর্য কমপ্লিমেন্ট জানিয়ে বলল যে উনি সত্যিই একজন ‘ইয়ং হাজ়ব্যান্ড।” বৃদ্ধ হেসে বললেন, “আই অ্যাম নাইন্টি টু অ্যান্ড নেভার ম্যারেড। সো নাইদার ইয়ং নর এ হাজ়ব্যান্ড। হা হা…”
বৃদ্ধের সে কী বাচ্চা ছেলের মতো দু’হাত শূন্যে তুলে হাসি। ভাগ্যিস ক্যামেরাটা আমার হাতেই ছিল।
রিকিসুমের বাজারটা ছোট্ট কিন্তু জমজমাট। সব দোকানেই সব কিছু বিক্রি হচ্ছে। সবজি, স্টেশনারি, সিগারেট, বিস্কুট, কেরোসিন তেল কী নেই। এমনকী লেপ তোষক পর্যন্ত। আমার এরকম জায়গায় ছবি তুলতে খুব ভাল লাগে। বিশেষ করে যদি রাস্তার কুকুরগুলোকে ফ্রেমে পাওয়া যায়। তাসোকে বাজারে যেই দেখে হাসিমুখে প্রশ্ন করে, “খামরি মো, আকেত দো?”
বোঝাই যায় যে উনি এখানে বেশ জনপ্রিয়। সকলেই ওঁর কুশল প্রশ্ন করছেন। এক লেপচা মহিলা বাড়ির রোয়াকে বসে মোমো সেদ্ধ করছেন। দারুণ গন্ধ বেরিয়েছে। মহিলাটি তাসোকে দেখেই একগাল হেসে বেঞ্চির উপরে বসতে বললেন। আমরা গরম-গরম মোমো আর কফি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে ব্রিটিশ এক্সপ্লোরার্স বাংলোর ধ্বংসাবশেষের পথে হাঁটতে শুরু করলাম।
পাহাড়ি চড়াই পথ। হেঁটে আসতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক লাগল। তাসো অবশ্য আমাদের অনেক আগেই পৌঁছে অপেক্ষা করছিলেন। সামনের কিছুটা অংশ বাদ দিলে বাংলোটা এখন একটা ভাঙা ইটের স্তূপ ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। আমার ছবিগুলো তেমন জমল না। তাসো খুব দুঃখ করে বললেন, গত কয়েকবছরে জায়গাটার যে এতটা অবনতি হয়েছে, উনি জানতেন না। স্থানীয় বস্তির লোকেরা জানলা দরজাগুলো প্রায় সবই খুলে নিয়ে গিয়েছে। একজন লেপচা হিসেবে উনি আমাদের কাছে ক্ষমা চাওয়াতে আমরা ওঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, অশিক্ষা ও দারিদ্রের জন্য আমাদের দেশে এরকম কত অমূল্য সম্পদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এ লজ্জা আমাদের সকলেরই। ওঁর একার নয়।
এবার আমরা ক্রস হিল যাব। তাসো গ্রামের একজনকে অনুরোধ করায় সস্তায় একটা জোঙ্গা গাড়ির বন্দোবস্ত হয়ে গেল। ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। তবে রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। পাহাড়ের মাথায় পোঁতা বিশাল কাঠের তৈরি ক্রসটার নীচে বসে ফাদার অগাস্তিন দেসগদিন্সকে মনে-মনে ধন্যবাদ জানালাম। এত সুন্দর জায়গায় ক্রসটা রাখা যে, সেখান থেকে সুদূর তিব্বতের পাহাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আর সকলের পিছনে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথাটা। আকাশে মেঘ ছিল না। কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় জমা বরফের উপর লালচে-হলুদ রংয়ের চোখ ঝলসানো
বিকেলের রোদ। ওরকম পাহাড়ের রং আমি আগে দেখিনি।
জনমানবহীন ক্রস হিলের মাথায় এসে পৌঁছনোর পর থেকে তাসোকে কেমন যেন আনমনা হয়ে যেতে লক্ষ করলাম। চুপচাপ একটা পাথরের উপর বসে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটি কথাও বললেন না। সূর্য এরকম জায়গায় এলে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা পছন্দ করে না। ও বলে নীরবতা ইতিহাসকে কথা বলায়। আমিও আমার মতো করে জায়গাটার অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য ও নিশ্ছিদ্র নীরবতা অনেকক্ষণ ধরে উপভোগ করলাম। প্রচুর ছবিও তুললাম। সূর্যাস্তের মুখে জোঙ্গার ড্রাইভার তাসোকে ফেরার কথা মনে করিয়ে দিল। পথে লেপচা বস্তির মেয়েরা খেত থেকে তোলা ভুট্টা আগুনে সেঁকে বিক্রি করছিল। গাড়ি থামিয়ে কিনলাম। খেতে দারুণ।
তাসোর বাড়ির পাহাড়টায় আসতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। আমাদের গাড়িটা যেখানে পার্ক করা আছে, সেখানে পৌঁছে সূর্যই কথাটা পাড়ল। ও সকালে বাজারে একটা ভাড়ার ঘর দেখে এসেছে। আজ রাতটা আমরা ওখানেই উঠব। তাসোর যদি ইচ্ছে থাকে তো কাল সকালে মোমোর দোকানে তিন জনে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট সেরে দামসাং দুর্গ দেখতে যাব। ১৯৬০ সালে তৈরি এবং বহু যুদ্ধের সাক্ষী লেপচা রাজাদের এই দুর্গের কথা ম্যাগাজ়িনের লেখাটায় পড়েছি। তাসো বেশি কথার লোক নন। শুধু বললেন, “সকালে বেরনোর আগেই রুটি আর ভেড়ার মাংসের বন্দোবস্ত করে গিয়েছি। শোওয়ার জন্য চিন্তা নেই। অনেক ঘর আছে।”
কথাটা শেষ করেই উনি আমাদের ঠিক মাথার উপরের বাংলোটার দিকে হাত তুলে দেখালেন।
সন্ধের আলো-আঁধারিতে আমি একবার সেই নির্জন পাহাড়ে, জঙ্গলে ঘেরা, পরিত্যক্ত বাংলোটার দিকে তাকিয়ে সূর্যর চোখের দিকে তাকালাম। যদিও জানি এরকম প্রস্তাবে সূর্য না বলার ছেলে তো নয়ই, বরং মনে-মনে খুশিই হবে! দেখি, ও এক দৃষ্টিতে বাংলোটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অগত্যা মনে-মনে ধরেই নিলাম যে আজ রাতে কপালে কিছু একটা লেখা আছে। সঙ্গে-সঙ্গে এটাও মনে হল যে গাড়ির ডিকি থেকে সাত সেলের টর্চ লাইটটা আর সুইস নাইফটা নিয়ে নিতে হবে। কখন কোনটা কাজে লাগে।
রাত ন’টা বাজে। এখানে এটাই গভীর রাত। রান্না এবং খাওয়াদাওয়া দু’টোই তাসোর ঘরের সামনে খোলা জায়গাটাতেই হল। গা ছুঁয়ে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। আকাশে অগুন্তি তারা। সামনে দাউদাউ করে জ্বলা পাইন গাছের ফলের আগুনের গরমে মাটিতে বসে মোটা রুটি, চমত্কার নরম ভেড়ার মাংস আর লেবুর আচার, যাকে বলে ডিনার। যে লোকটি রান্না করে খাওয়াল, সে আগুন নিভিয়ে অন্ধকারেই জঙ্গলের রাস্তা ধরে পাহাড়ের নীচের গ্রামে অনায়াসে নেমে গেল।
রাতের সঙ্গে-সঙ্গে ঠান্ডাটাও জাঁকিয়ে পড়েছে। মাঝে-মাঝে একটা দমকা হাওয়া। আমি আর সূর্য দু’জনে তাসোর পিছনে-পিছনে পাথর ফেলা সিঁড়িটা দিয়ে উপরের বাংলোয় শুতে যাচ্ছি। চাঁদের যথেষ্ট আলো রয়েছে। টর্চ জ্বালার প্রয়োজন হচ্ছে না। বাংলোর চারপাশ ঘিরে একটা নিচু পাথরের পাঁচিল এঁকেবেঁকে পাহাড়ের গা বেয়ে চলে গিয়েছে। ওই পাঁচিল টপকেই আমাদের বাংলোর বাগানে ঢুকতে হল। একটা নুড়ি পাথরের ড্রাইভ-ইন মতো পেরিয়ে তাসো বাংলোর সদর দরজাটা ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল। দরজায় কোনও রকম তালা বা খিল কিছুই ছিল না দেখে অবাক হলাম। অন্ধকারেই দেখলাম বাংলোর একতলাটা একটা বিশাল হলঘর। হলের মাঝখান থেকে একটা চওড়া কাঠের সিঁড়ি দোতলায় উঠে দু’দিকের বারান্দায় মিশে গিয়েছে। অনেকটা ইংরেজি সিনেমার মতো।
তাসো হল ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে একটা পুরনো খবরের কাগজে আগুন ধরালেন। কাগজটা জ্বলে উঠতেই একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। শয়ে-শয়ে এক ধরনের পোকা ঘরের ভিতর থেকে ডানা মেলে উড়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে লাগল। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই! অন্ধকারে যত দূর মনে হল, পোকাগুলোর রং কালো আর সাইজ়ে অনেকটা প্রজাপতির মতো। প্রায় মিনিটপাঁচেক ধরে তাসো একটার পর একটা কাগজ পোড়ালেন আর পোকাগুলো অনর্গল হলের ভিতর থেকে বেরিয়ে যেতে থাকল। এবার তাসো নিজের পকেট থেকে একটা মোমবাতি বের করে জ্বালালেন। ওঁর পিছন-পিছন আমরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দোতলার ডান দিকের একটা ঘরে ঢুকলাম।
ঘর জুড়ে একটা বিশাল পালঙ্ক। উঁচু ছত্রী থেকে সাদা মশারিটা ঝুলছে। পুরনো দিনের নানা রকম দামি কাঠের আসবাব। মেঝেতে পুরু লাল কার্পেট। অব্যবহারের একটা সোঁদা গন্ধ। দেওয়ালের পাশাপাশি দুটো বিশাল অয়েল পোর্ট্রেট। মোমবাতির আলোয় ছবি দুটো একই সাহেবের বলে মনে হয়। এমনকী জামাকাপড়গুলোও এক। আমি ঘরের জানলাগুলো খুলে দিতেই ঘরের ভিতর থেকে আরও কিছু পোকা উড়ে বেরিয়ে গেল। তাসো বিছানাটা দেখিয়ে বললেন,“আরাম করে ঘুমোও। সকালে আমার ওখানেই চা।”
অন্ধকারে তাসোর ছায়াটা বাংলোর পাঁচিল টপকে আস্তে-আস্তে পাহাড়ের নীচে নেমে যেতে দেখলাম। সূর্য অনেকক্ষণ একটা কথাও বলেনি। কী ভাবছে, কে জানে। একমনে জানলা দিয়ে দূরে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আমিই প্রথম নিস্তব্ধতা ভেঙে বললাম,“চল টর্চটা নিয়ে বাড়িটা আগে একবার ঘুরে দেখে আসি।”
ও বলল,“সুইস নাইফটা আমায় দে তো।”
সাত সেলের টচর্টার সুইচ টিপতেই পোকার ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আমাদের মাথার উপরে কড়িকাঠে লক্ষ-লক্ষ গুটিপোকা বাসা করে আছে। বুঝলাম, কাগজের আগুনের ধোঁয়ায় বেশ কিছু মথ গুটি ভেঙে উড়ে বেরিয়ে গেল। ম্যাগাজ়িনের লেখাটা মনে করিয়ে দিল যে, এক সময় এখানকার মালবেরি পাতা আর রেশম চাষ বিখ্যাত ছিল।
বাংলোর দোতলার কাঠের টানা বারান্দাটা সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে দু’পাশে লম্বা হয়ে চলে গিয়েছে। ল্যান্ডিংয়ের ডানদিকের প্রথম ঘরটাতে তাসো আমাদের শুতে বলে গিয়েছেন। এরপর সার-সার আরও তিনটে ঘর পেরিয়ে বারান্দাটা ডান দিকে শেষ হয়েছে। সব ঘরেরই দরজা খোলা। টর্চের আলোয় দেখলাম এগুলো সবই বেডরুম। আসবাবপত্র প্রায় একই রকম। কিন্তু একটা ব্যাপার আমাদের খুব অবাক করল। প্রত্যেকটা বেডরুমের দেওয়ালে একই সাহেবের পাশাপাশি দু’খানা করে বিশাল অয়েল পোর্ট্রেট। অবিকল এক ছবি! এটা নিছক খেয়াল নাকি এর পিছনে কোনও রহস্য আছে বুঝতে পারলাম না। আমরা এবার ল্যান্ডিংয়ের বাঁদিকের ঘরগুলোর দরজা খুলে-খুলে দেখতে শুরু করলাম। প্রথমটা স্টাডি। প্রচুর বই, একটা বড় টেবলের সামনে সুন্দর চেস্টারফিল্ড গদি আঁটা কয়েকটা চেয়ার সাজানো। ঘরটার মাঝখানে দেওয়াল জুড়ে আবার ওই একই সাহেবের দু’খানা পাশাপাশি অয়েল পোর্ট্রেট। এক রং, এক পোজ়, সবকিছু অবিকল এক। লেপচাদের ড্রেস পরে দারুণ লাগছে সাহেবকে। জানলার দিকে মুখ করে বসানো একটা বিশাল পেতলের টেলিস্কোপ। মনে-মনে ঠিক করলাম, কাল সকালে আকাশ পরিষ্কার থাকলে এটা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথার বরফটা দেখতেই হবে।
এর পরের ঘরটা একদম ফাঁকা। ছাদে অসংখ্য গুটিপোকা আটকে আছে। মনে হয় সাহেব এটা সাজানোর আগেই ছেড়ে চলে গিয়েছেন বা যেতে হয়েছে। এর পরের ঘরটাই এদিকের বারান্দার শেষ ঘর। ঘরটা লম্বায় বেশ বড়। কাঠের সুইং ডোরের পিছনে ভারী লাল স্যাটিনের পরদা ঝুলছে। পরদাটা তুলে দেখি ঘরজোড়া একখানা বিশাল বিলিয়ার্ড টেবল। সুন্দর সবুজ বোর্ডটার উপর রঙিন বলগুলো এদিক-ওদিক ছড়ানো। এমনকী কিউ স্টিক আর রেস্ট হেডগুলোও এখানে ওখানে পড়ে। মনে হয় কেউ বুঝি খেলতে-খেলতে একটু আগেই উঠে চলে গিয়েছে। এমন সময় হঠাত্ একটা কান ফাটানো বন্দুকের গুলির শব্দে দু’জনে চমকে উঠলাম। ঠাক্! সূর্য সঙ্গে-সঙ্গে বলল,“টর্চটা নিভিয়ে দে।”
অন্তত মিনিটদশেক অন্ধকারে বিলিয়ার্ড টেবলটার একপাশে আমি আর সূর্য লুকিয়ে রইলাম। শুধু আরও কয়েকটা মথের এদিক ওদিক উড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও শব্দ হল না। আমার হাতঘড়ির রেডিয়ামের আলোয় দেখলাম রাত সাড়ে দশটা। সন্তপর্ণে বাইরের বারান্দায় এসে দেখলাম নীচে হল ঘরেও সব শান্ত। পা টিপে-টিপে বাঁদিকের লম্বা টানা বারান্দাটা পেরিয়ে আমাদের ঘরটায় ঢুকতে যাব, আবার ওই গুলি ছোঁড়ার শব্দ। ঠাক! দ্বিতীয় বার।
শিলিগুড়ি থেকে মিরিকের পথে একবার মিলিটারিদের রাইফেল শুটিং প্র্যাকটিস দেখেছিলাম। ঠিক এই আওয়াজ। নির্জন পাহাড়ের মাথায় জঙ্গলে ঘেরা পরিত্যক্ত বাংলোর নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে সে গুলির শব্দ যেন শরীরের রক্ত ঠান্ডা করে দিয়ে গেল। আমি আর সূর্য ঘরের ভিতরে ঢুকে এসে জানলার খড়খড়ির পাশে নিজেদের আড়াল করে দাঁড়ালাম। সূর্যর হাতে খোলা সুইস নাইফটা শক্ত করে ধরা। দু’-একটা গাছের পাতা ছাড়া বাইরে কোথাও কিছু নড়ছে বলে মনে হল না। আকাশে মেঘ এসেছে, তাই কাছের পাহাড়টাও অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছে। কোন দিক থেকে যে গুলির শব্দ আসছে সেটা আন্দাজই করা গেল না। আমরা কোনও কথা না বলে দু’জনে চোখ জ্বেলে দাঁড়িয়ে রইলাম। মিনিট পনেরো পরে ওই আওয়াজটা আবার হল। এই নিয়ে তিনবার।
মনে হল, আওয়াজটা বাংলোর বাঁদিকের ঝোপজঙ্গল থেকে আসছে। সূর্যকে ইশারায় ইঙ্গিত করলাম নীচে যাওয়ার জন্য। ও সুইস নাইফটা আমার হাতে দিয়ে খাটের মশারির একটা ছত্রী খুুলে হাতে নিল। আমার বাঁ হাতে টর্চ, ডান হাতে খোলা সুইস নাইফ। দু’জনে নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। ভাগ্যিস তাসো সদর দরজাটা যাওয়ার সময় খুলেই রেখে গিয়েছিলেন, তাই দরজা খোলার কোনও শব্দ হল না। বাইরে বাগানে এসে দাঁড়িয়েছি, সঙ্গে-সঙ্গে কান ফাটানো আওয়াজ। ঠাক্! এই নিয়ে চারবার।
সাত সেলের জোরালো আলোটা ফেলতেই যা দেখলাম, তা শুধু অভাবনীয় নয় এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। বাগানের এদিকটায় বৃষ্টির জল যাওয়ার জন্য একটা সরু নালা মতো চলে গিয়েছে। নালাটার উপর একটা ছোট সাইজ়ের কালভার্ট, ব্রিজের মতো করে সাজানো। কালভার্টটার এ মুখে একটা গোখরো সাপ ফণা তুলে দাঁড়িয়ে। আর ও মুখে একটা বিশাল চেহারার ব্যাঙ সাপটার পথ আটকে বসে। দু’জনেই রাগে ফুঁসছে। সাপটা যেই ব্যাঙটাকে ছোবল মারতে যাচ্ছে, ব্যাঙটা একটা বিকট আওয়াজ করে সাপটাকে ভয় দেখাচ্ছে।
কালভার্টটার নিচে ব্যাঙের সে প্রতিবাদ রাতের নিস্তব্ধতায় ঠিক গুলির আওয়াজের মতো শোনাচ্ছে। আমাদের আকস্মিক উপস্থিতিতে সাপটা হিসহিস করতে-করতে জঙ্গলে চলে গেল। ব্যাঙটাকে কিন্তু নড়তে দেখলাম না। মনে হয় ক্লান্ত।
আমরা দু’জনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে একাট পাথরের উপরে বসলাম। মেঘ সরে গিয়ে আকাশে আবার চাঁদের আলো রুপোর মতো চকচক করছে। সূর্য বলল, “দেখিস, সুইস নাইফটায় কিন্তু ভীষণ ধার। ওটা আগে বন্ধ করে পকেটে রাখ।”
দোতলার বারান্দা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা মাথায় অপূর্ব সূর্যোদয় দেখে তাসোর বাড়িতে চায়ের আশায় নেমে এলাম। স্টাডি রুমের টেলিস্কোপটা অব্যবহারে ফোকাসই করা গেল না। দুঃখ রয়ে গেল। তাসো “গুড মনির্ং” জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের সানরাইজ় কেমন লাগল। বুঝলাম উনি নিচে থেকে বাংলোর বারান্দায় আমাদের দেখেছেন।
আমি বললাম “সানরাইজ় দারুণ। তবে কাল রাতের অভিজ্ঞতার কাছে কিছুই নয়।” চার চারটে গুলির শব্দের ঘটনাটা ডিটেলে বলাতে ওঁর মুখে আবার সেই অপার্থিব হাসিটা ফুটে উঠল। একটা স্বগতোক্তির মতো বললেন,“আই সি, তার মানে দুই ভাই কাল রাতে উপরেই ছিল! কেন যে ওরা এত ঝগড়া করে! আর পারি না।”
আমি আর সূর্য দু’জনে দু’জনের দিকে তাকালাম। সূর্য হেঁয়ালিটায় আমল না দিয়ে তাসোর দিকে এক পা এগিয়ে গেল। ওর দু’কাঁধের উপর দু’হাতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল,“এবার বলুন তো বাংলোর সাহেবটি কে? কী তার নাম? কেন উনি জোড়া-জোড়া ছবি রাখতেন? আর ব্রিটিশ বাংলো আর ক্রস হিলের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্কটাই বাকী?”
আমি লক্ষ করলাম তাসোর মুখ থেকে ওঁর স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা সরে গিয়ে কপালে আরও কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। উনি মাটির দিকে তাকিয়ো শুধু বললেন,“বোসো।” আমরা মাটিতে পাতা কম্বলটার উপরে বসে পড়লাম। উনি শুরু করলেন, “ফ্রান্সিস ইয়ংহাজ়ব্যান্ডের নাম তোমরা নিশ্চয়ই শোনোনি। ওঁর জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের মুরি হিল্সে ১৮৬৩ সালে। বাবা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার মেজর জেনারেল। ছেলেও ইংল্যান্ডের রয়্যাল মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে ১৮৮১ সালে কমিশনড্ হল। পাঁচ বছর পর গ্রীষ্মের ছুটিতে দুই বন্ধুর সঙ্গে মাঞ্চুরিয়া বেড়াতে গিয়ে সেখানকার মানচিত্র, স্থানীয় চিনাদের জীবনযাত্রা, পর্বতশৃঙ্গগুলোর উচ্চতা ইত্যাদি প্রভূত তথ্য প্রকাশ করে ছেলেটা বেশ নাম করে ফেলল। এরপর একা গোবি মরুভূমি পার হয়ে চাইনিজ় তুর্কিস্তান পৌঁছে পিকিং থেকে ইয়ারখন্দ হয়ে কাশ্মীর আসার মুস্তাঘ পাসের ম্যাপ ওই প্রথম প্রস্তুত করে। এই কাজের জন্য মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি ফ্রান্সিসকে সোনার মেডেল দিয়ে সদস্য করে নিল বলে কী হইচই। ফ্রান্সিসের সাধারণ জীবনে মন বসত না। ওর তখন মাত্র সাতাশ বছর বয়স। সে বয়সেই মাত্র কয়েকজন গোর্খা সৈন্য নিয়ে লাদাখ থেকে কারাকোরাম পর্বতমালার ভিতরের দুর্গম অঞ্চলে দস্যুদের উত্পাত দমন করে ও ভারত ও চিনের বাণিজ্যের পথ খুলে দিল।” তাসো একমনে বলে যাচ্ছেন। সূর্যর চোখও স্থির। ও যে মনে-মনে ফ্রান্সিসের পাশে-পাশে কারাকোরামের দুর্গম পথে ঘোড়ায় চেপে চলেছে, এ আমি বেশ বুঝতে পারছি।
“তোমরা কলকাতার ছেলে,লর্ড কার্জনের নাম নিশ্চয়ই শুনেছ। ভাইসরয় কার্জন একবার গুপ্তচর মারফত খবর পেলেন যে রাশিয়ানরা হিন্দুকুশ পর্বত দিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে এবং বেশ কিছু সেনা ইতিমধ্যেই তিব্বতের ভিতরে ঢুকে ঘাঁটি গেড়েছে। লর্ড কার্জনের দপ্তরে ফ্রান্সিস ইয়ংহাজ়ব্যান্ডের ডাক পড়তে দেরি হল না।
“দিনটা হল ১৯৩০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় বছরের শেষ সূর্যোদয় হচ্ছে। রিকিসুমে ভোরের কঠিন ঠাণ্ডাতেও সেদিন গরম হাওয়া বইছে! লেপচারা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ‘কং-লো-চু’ বলে ডাকে। ‘কং-লো-চু’র মাথায় সেদিন সূর্যের রং অদ্ভুত রকমের লাল, তাজা রক্তের মতো! রিকিসুমের পাহাড়ের মাথায় ফ্রান্সিস ইয়ংহাজ়ব্যান্ডের ছোট্ট সেনাবাহিনীর বিউগল বেজে উঠল। লেপচা বস্তির প্রতিটি ঘর থেকে জোয়ান ছেলেরা বেরিয়ে এসে ফ্রান্সিস ইয়ংহাজ়ব্যান্ডের সেনা পাহাড়ের পথ দিয়ে মার্চ করে এগিয়ে গেল তিব্বত সমরে। ওদিক ক্রস হিলের মাথায় বৃদ্ধ লামারা রঙিন কাপড় উড়িয়ে উলুধ্বনি দিচ্ছেন আর সকলে আশীর্বাদ করছেন। সকলের পিছনে ফ্রান্সিস। আর সকলের আগে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার পতাকা হাতে চলেছে ছাব্বিশ বছরের এক দৃপ্ত লেপচা যুবক। তার নাম তাসো লেপচা।”
আমরা লক্ষ করলাম, তাসোর দু’চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু সে জল যে আনন্দের নয়, তখনও বুঝতে পারিনি। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে তিনি আবার শুরু করলেন,“তিব্বত সীমান্ত পেরোতেই আমাদের যুদ্ধ শুরু হল। একের পর এক গ্রাম শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করতে-করতে আমরা জয়ের নেশায় উন্মত্ত হয়ে এগোতে থাকলাম। মানুষের মৃত্যু যে এত নেশা ধরাতে পারে জানতাম না। সাত মাসে অন্তত একশো মানুষ আমার হাতে প্রাণ হারাল। আমার বীরত্বকে পুরস্কৃত করতে একদিন রাতে ফ্রান্সিস আমাকে ওঁর তাঁবুতে ডেকে পাঠাল। সকলের সামনে আমাকে একটা মেডেল পরিয়ে স্যালুট করে বলল, ‘তাসো, তুমি শুধু লেপচা জাতির শৌর্য ও বীযের্র প্রতীক নও। তুমি আমারও গর্ব। তাই তোমাকে আজ থেকে আমার নাম ব্যবহারের অনুমতি দিলাম। আজ থেকে তোমার নাম হল তাসো ইয়ংহাজ়ব্যান্ড লেপচা,’ আমাদের দলের সকলের হাততালি পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হল। এত বড় সম্মান আমি আশা করিনি, আমার কোনও প্রয়োজনও ছিল না।” সূর্য তাসোকে ডান হাতের চারটে আঙুল জড়ো করে একটা ছোট্ট কুর্নিশ করল। কিন্তু আমার যেন মনে হল তাসো তাতে খুশি হলেন না।
উনি গম্ভীরভাবে বলতে শুরু করলেন,“পরদিন ভোরে আমরা এক তিব্বতিদের গ্রামের বাইরে তোপধ্বনি করলাম। ওই গ্রামটায় লামাদের প্রাচীন মনাস্ট্রি ছিল। মনাস্ট্রির বিশাল কাঠের দরজাটা বাইরে থেকে একটা আগল দিয়ে বন্ধ দেখে অনুমান করলাম যে, শত্রুরা নিশ্চয়ই মনাস্ট্রিটা অধিকার করে কাছেই কোথাও লুকিয়ে আছে। আমার দলে তখন দু’টি অল্প বয়স্ক ইংরেজ সৈন্য ছিল। ক্যাপ্টেন ফ্রেডরিক আর ক্যাপ্টেন প্যাট্রিক। যমজ ভাই, সদ্য ভারতে এসেছে। ওরা আমারই কাছে পাহাড়ে ওঠা, খচ্চরের পিঠে চড়া ইত্যাদি শিখেছে। আমিই ওদের কম্যান্ড করলাম মনাস্ট্রিটার দখল নিতে। একটা মাঝারি সাইজ়ের কামানে বারুদ ভরে ফ্রেডরিক আর প্যাট্রিক দু’জনে মনাস্ট্রিটার বন্ধ দরজার সামনে পজ়িশন নিল। আমার তখন নতুন উত্সাহ। একাই এগিয়ে গিয়ে দরজাটা এক ধাক্কায় খুলে দিলাম।”
বেশ বুঝতে পারছি, তাসোর গলাটা কাঁপছে। উনি একটু জোরে শ্বাস নিয়ে বললেন,“দরজাটা খুলতেই আমি বুঝতে পারলাম যে, আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। মনাস্ট্রির বিশাল উঠোনটায় সমস্ত লামারা মাটিতে বসে নীরবে বুদ্ধের উপাসনা করছেন। হয়তো শত্রুর হাত থেকে মনাস্ট্রিটা বাঁচানোর প্রাথর্নায়। দরজা খোলার শব্দে ওঁদের বিন্দুমাত্র বিচলিত হতে দেখলাম না। আমি মুহূর্তে আমার ভুল বুঝতে পেরে ফ্রেডরিককে কামানে আগুন দিতে বারণ করার জন্য যেই পিছনে ঘুরেছি পরপর গোলা গিয়ে পড়তে লাগল ওই ধ্যানস্থ লামাদের মাঝে। ওঁরা কেউ বাঁচার চেষ্টাও করলেন না। যেন স্বেচ্ছায় নিশ্চিত মৃত্যুর প্রতীক্ষাতেই বসে ছিলেন। একবার সকলেই একসঙ্গে বুদ্ধের নাম উচ্চারণ করলেন। তারপর সব শেষ! আমার একটু ভুলের জন্য সেদিন ৫৭৪ জন লামা বিনা অপরাধে, বিনা যুদ্ধে রক্তে ভেসে গেলেন। খোলা দরজাটার পাশে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে আমি নিজে আমার খুনের সাক্ষী রইলাম। আমার জুতো দু’টো দরজা থেকে গড়িয়ে আসা তাজা রক্তে ভিজে গেল। নিরীহ পবিত্র লামাদের অকারণ মৃত্যু আমাদের সেনাবাহিনীর সমস্ত গোর্খা ও লেপচাদের মনোবল চুরমার করে দিল। অনুতাপে বিদগ্ধ হয়ে আমি, ফ্রেডরিক আর প্যাট্রিক একদিন কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে এলাম।”
সূর্য আর আমি মাটিতে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে শুনছি। তাসো মাঝে-মাঝেই জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। বুঝতে পারছি উনি কান্না চাপার চেষ্টা করছেন। আমার ওঁর জন্য কষ্ট হল।
“একটা গোটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে। ১৯০৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর, মাঝ রাত। রিকিসুমের লেপচা বস্তি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। আমরা তিনজন মানুষ অন্ধকারে গ্রামের ভিতরে এসে ব্রিটিশ বাংলোটার সামনে দাঁড়ালাম। বহু দিনের ক্লান্তি, দেহের নানান জায়গায় ক্ষত, মন বিধ্বস্ত। আমারই ভুলে এতজন নিরীহ ধর্মপ্রাণ লামাদের মৃত্যুর অনুতাপ আমাকে দিন রাত কুরে-কুরে খাচ্ছে। মনে আছে, পাড়ার কুকুরগুলো সে রাত্রে আমায় চিনতে পেরে খুব চিত্কার করেছিল। সে কী লজ্জা!”
সূর্য সান্ত্বনা জানিয়ে বলল, “ফ্রেডরিক আর প্যাট্রিকই তো এর আসল দোষী। আপনি গোলা ছোঁড়ার আদেশ দেওয়ার আগেই তো ওরা গোলা ছুঁড়েছিল।” তাসো বললেন, “কথাটা ঠিক। ওরা দুই ভাই নিজেরাও যথেষ্ট অনুতাপে ভুগত। আর এই নিয়ে দু’জনের সারাক্ষণ ঝগড়া লেগেই থাকত। ফ্রেডরিক “ফায়ার” বলে চেঁচিয়ে ওঠার পরেই সে কামানে আগুন দেয়। ওদের ঝগড়া আমাকেই সামলাতে হত। লামাদের এই অকারণ মৃত্যুর ম্যাসাকারটা লন্ডনেও জানাজানি হওয়ার জন্য ফ্রেডরিক আর প্যাট্রিক লজ্জায় দেশে ফিরতে চায়নি। এখানেই দু’টি অবিকল এক দেখতে বাংলো বানিয়ে থেকে গেল। এমনিতে দুই ভাইয়ে যথেষ্ট ভাব থাকলেও মাঝে-মাঝেই ওদের সেই পুরনো বচসা শুরু হত আর রাত বিরেতে আমাকে উপরে গিয়ে ওদের সামাল দিতে হত। শেষের দিকে দু’জনেই মানসিক অবসাদে ভুগত আর থেকে-থেকে একে অপরকে “ফায়ার! ফায়ার!” বলে চিত্কার করত।
দিনটা ছিল ১লা জানুয়ারি, ১৯১০ সাল। ফ্রেডরিক আর প্যাট্রিক দু’জনের দু’টো বাংলোতেই নিউ ইয়ার্সের সেজবাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। ফ্রেডরিকের বাংলোটা নীচে বলে গ্রামের নিমন্ত্রিতরা ওখানেই একটু পরে আসবেন। বাগানের একপাশে রুটি আর ভেড়ার মাংস রান্না হচ্ছে। আমি বাংলোর হলঘরটার ভিতরে টোংবা পরিবেশনের আয়োজন করেছি। হঠাত্ দোতলার বিলিয়ার্ড রুমের ভিতর থেকে পর-পর চারটে গুলি ছোড়ার আওয়াজ শুনে দৌড়ে উপরে গেলাম। সুইং ডোরটা খুলতেই দেখি বিশাল সবুজ টেবলটার উপরে রক্তাক্ত দু’টো দেহ দু’পাশে পড়ে আছে। দুই ভাইয়ের হাতেই গরম পিস্তল। দু’জনেরই বুকে দু’খানা করে গুলি। বাতাসে বারুদের গন্ধ। বিলিয়ার্ড বোর্ডটার পকেট থেকে বেরিয়ে আসছে গরম তাজা ইংরেজ রক্ত।”
কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকার পর তাসো উপরে ফ্রান্সিসের বাংলোটার দিকে মুখ তুলে দু’হাত জড়ো করে অস্ফুট শব্দে বললেন, “হে ভগবান! ধর্মপ্রাণ লামাদের অকারণ মৃত্যুর জন্য তুমি দুই ভাইকে শাস্তি দিয়েছ। আমিও তোমার কাছে আমার পাপের শাস্তি প্রার্থনা করি। আমাকে যেন ক্ষমা কোরো না ভগবান!”
দু’হাতে মুখ ঢেকে তাসোকে শিশুর মতো কাঁদতে দেখে আমি আর সূর্য ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সে রাত্রে আমরা আর রিকিসুমে থাকিনি।
Social Links: