News Ticker

Menu

কলম্বাসের বাবা

কলম্বাসের বাবা
এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়

ভবানীপুর স্পোর্টিং-এর সঙ্গে আমাদের ক্লাবের খেলা, কাল বিকেল তিনটেয়-খবরটা গৌতম আগেই দিয়ে গিয়েছিল। তারপর আধ ঘণ্টাও হয়নি-জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম সাইকেল থেকে কেষ্টাকে নামতে। ঊর্ধ্বশ্বাসে পড়ার টেবিল ছেড়ে দৌড়েছি। খুব সময়ে পৌঁছে গেছি যা হোক। দেখি বাঁটুল গোড়ালি উঁচু করে ঘণ্টি টেপার চেষ্টা করছে, হাত পৌঁছচ্ছে না।

“বাজাস না।” গম্ভীর গলায় বললাম। সকাল থেকে আমার বন্ধুদের ভাগাতে ভাগাতে মা টায়ার্ড। আবার এখনি ঘণ্টি বাজলে মহা কেলেঙ্কারি হত।
“শোন, তোকে ভয়ঙ্কর দরকার।” কেষ্টা বলল।
“জানি। খেলা তো? গৌতম বলে গেছে।”
“তুই আসবি। তোকে খেলতে হবে। পরীক্ষা-ফরীক্ষা দেখাস না।”
“পরীক্ষা-ফরীক্ষা মানে? ইয়ার্কি পেয়েছিস? পরীক্ষা দিতে হবে না?”
“দিতে তো হবেই। পরীক্ষা সব সময়েই দিতে হবে। তবে কাল দুপুরে তুই খেলতে আসছিস। আমাদের ম্যান কম পড়েছে।”
“আমাকে বাদ দে।” কেষ্টার মত আকাট মুখ্যুকে কিছু বোঝানো সম্ভব না। মাসের মধ্যে অন্তত পনেরো দিন যে ক্লাস কেটে সিনেমা দেখতে চলে যায়, সে কী করে বুঝবে পরীক্ষার মর্ম! স্কুল ফাইনালে পাশ-ফেলের উপর সমস্ত ভবিষ্যত্, চাকরি পাওয়া, ও তার কী জানতে গেল। আমিও অবশ্য খুব বেশী জানতাম না, তবে যেদিন থেকে বাবা বলেছেন চাকরি না পেলে না খেয়ে থাকতে হবে, সেদিন থেকে ব্যাপারটা বুঝতে আরম্ভ করেছি। কিন্তু ম্যান কম পড়েছে শুনে থমকে যেতে হল।
“কে খেলছে না?”
“পিকু গেছে মামার বাড়ি। দেবাশিসের জ্বর। শান্তনু বিশেষ কাজে ব্যস্ত।”
শান্তনুর বিশেষ কাজ কী, তা আমার ভালভাবেই জানা। ও-রকম বিশেষ কাজে ও চব্বিশ ঘণ্টাই ব্যস্ত। “ঠিক আছে, ঠিক আছে, শান্তনুকে আমি রাজি করিয়ে দেব। তাহলে হচ্ছে তো এগারো জন।”
*
দরজায় সাঙ্কেতিক টোকা মারতেই শান্তনু জানিয়ে দিল কেটে পড়তে। ওর নাকি কথা বলার সময় নেই। এখন কারো সঙ্গে দেখা করা তো দূরের কথা। আমিও কি ছাড়বার পাত্র!
অনেক ধাক্কাধাক্কির পর যখন পুরো গ্যাং নিয়ে আসার ভয় দেখালাম, তখন ও এই এতটুকু ফাঁক করল। সেই সুযোগে দিয়েছি কাঁধটা ঢুকিয়ে। ঠেলাঠেলি, হুড়োহুড়ি, ধস্তাধস্তি-শেষ পর্যন্ত আমার জিত। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে হাত-পাগুলো সেট করে নিচ্ছি, এই ফাঁকে শান্তনু আর একটা ল্যাং মারার চেষ্টা করেছে। কিন্তু হবি তো হ, নিজেরই টেবল-ল্যাম্পের লম্বা তারে পা জড়িয়ে সমস্ত এনার্জি সমেত নিজেই মাটিতে পড়েছে ধাঁই করে। তখন আমাকেই এগিয়ে এসে উদ্ধার করতে হল ওকে।
শান্তনু ইলেকট্রিক আলো নিয়ে সর্বদাই নানা রকম পরীক্ষা করছে। ওর ঘরে নানা রকম কায়দার আর পাওয়ারের আলোর ছড়াছড়ি। মেঝেয় এত রকম তার এদিক থেকে ওদিক গেছে যে পাপোষ চাপা থাকা সত্ত্বেও হোঁচট না খেয়ে চলা শক্ত। কখন কোথায় কী সুইচ লাগাচ্ছে, কোন তার জুড়ছে! ঘরটার একটা বিতিকিচ্ছি চেহারা। আজ নির্ঘাত কোন নতুন রকম আলো লাগাবার চেষ্টা চলছে, তাই এত সাবধানতা। গত সপ্তাহে স্বপ্ন দেখার আলো বানাতে গিয়ে ফিউজ উড়েছিল। তখন আবার বাইরের ঘরে মেশোমশাইয়ের অফিসের কয়েকজন জরুরী কথাবার্তা বলতে এসেছিলেন। তারপর থেকে শান্তনুর ইলেকট্রিকাল এক্সপেরিমেন্টের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী হয়ে গেছে।
আমি উত্সাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী বানালি দেখা।”
“আরে দাঁড়া দাঁড়া। দেখানো কী অত সহজে যায়?”
“পুরোটা হয়নি বুঝি?”
“একটা বিরাট আবিষ্কারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। ঢুকতে হবে।”
“আবিষ্কার! হাসালি। তাও আবার তুই করেছিস! কেন ইলেকট্রিসিটি কি এর আগে কেউ আবিষ্কার করেনি নাকি?”
“দ্যাখ বুবলু, তুই এক একসময় কীরকম বোকা মেরে যাস। বিজ্ঞানের আবিষ্কার মানেই বুঝি ইলেকট্রিসিটি আর টেলিফোন? ওসব তো পরীক্ষার খাতায় ‘এসে’ লেখবার জন্য-বিজ্ঞান কি আবিষ্কার না অভিশাপ। আমার আবিষ্কারটা একেবারে নতুন না হলে-”
“নতুন না বলে আর আবিষ্কার কী?”
‘‘বুঝবি, বুঝবি, ক্রমে-ক্রমে বুঝবি। সব আবিষ্কারই নতুন হয় না!”
নাঃ, এর সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। একেবারে ইমপসিব্ল। আর কোন প্রশ্ন না করে খাটের উপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসলাম। একটু পড়েই মনে পড়ে গেল জুতোটা খোলা হয়নি-কিন্তু শান্তনুর মনপ্রাণ আবিষ্কারের উত্তেজনায় টগবগ করছে। ওসব দিকে নজর দেবার তার সময় কোথায়। তাছাড়া ওর নিজেরই, চান করে বেরিয়ে আসার পরেও আমি দেখেছি গোড়ালিতে কাদার ছোপ লেগে থাকে।
বসে বসে দেখতে লাগলাম ওর কান্ড-কারখানা। এর পড়ার টেবিলের পিছনের দেওয়ালে একটা বোর্ডের মতো জিনিস আছে- সেটা আসলে ঘষা কাঁচের পিছনে সবুজ পেন্ট করা। তার এদিক থেকে ওদিক অনেকগুলো লাট্টু টাইপের ছবি আঁকা হয়েছে। চেহারাগুলো দেখে যেন চিনি-চিনি মনে হয়। কিন্তু ভাল করে মনে আসে না। টেবিলের ওপর গোটা দশেক বই খোলা অবস্থায়, চেয়ারে কিসের যেন মডেল, শান্তনু নিজে মাটিতে উপুড় হয়ে অঙ্ক কষছে।
দরজায় টোকা পড়ল। শান্তনু হুঙ্কার দিয়ে উঠল, “আবার এসেছে বিরক্ত করতে!”
“চা, দাদাবাবু।” খুদিরামের সঙ্গে খাবারের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ বলে ওকে আমি বরাবরই পছন্দ করি। শান্তনুর হুংকার শুনে খুদিরাম মোটেই দমল না।
“চা জলখাবারটা খেয়ে নিন দাদাবাবু। তারপর লেখাপড়া করবেন।”
“দ্যাখ খুদিরাম, বেশী ফ্যাচফ্যাচ করেছ তো ঐ গরম চা দেব তোমার মাথায় ঢেলে-”
আমি ততক্ষণে এক লাফে বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছি। খুদিরামের হাত থেকে খাবারের ট্রেটা তুলে নিয়ে বললাম, “কিচ্ছু চিন্তা নেই খুদিরাম। দাদাবাবু না খায় আমি তো আছি।”
খুদিরাম আমাকে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে আমার হাতে ট্রে সমর্পণ করে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিল। সম্ভবত আরো কিছু কচুরি আর আলুর দম সাপ্লাই করার উদ্দেশ্যে।
আমি চটপট গোটা তিনেক আলু একটা কচুরিতে মুড়ে মুখের মধ্যে চালান করে দিয়ে ভরাট গলায় বললাম, “এবার বুঝিয়ে বল।”
শান্তনুর দৃষ্টি তখন কচুরি ছাড়িয়ে আলুর দম পার হয়ে আরো সুদূরে প্রসারিত। সে কোন উত্তর দিল না।
“ঐগুলো কিসের নকসা এঁকেছিস?” সেকেন্ড কচুরিটা কবজা করতে করতে আমি আবার জিগেস করি।
“পরমাণু কাকে বলে খবর রাখিস?”
ও হরি। এতক্ষণে ব্যাপারটা বোধগম্য হল। ওগুলো হল নানা জাতের পরমাণুর নিউক্লিয়াস আর তাদের চারপাশে ছুটন্ত ইলেকট্রনদের ছবি। মেসোমশাই, মানে শান্তনুর বাবা একজন পরমাণু-বিজ্ঞানী। যেদিন থেকে উনি শান্তনুকে ওঁদের প্রোজেক্টের বিশাল ম্যাগনেট দেখিয়ে এনেছেন, তার পর থেকেই পরমাণুর ভূত শান্তনুর মাথায় ভর করেছে। মেসোমশাইদের মেশিনে নাকি পরমাণুর গুেঁড়া প্রচণ্ড জোরে ঘোরানো হবে। এমন জোরে যে, তার থেকে ছিটকে-ছিটকে প্রোটন, নিউট্রন সব বেরিয়ে আসবে আর মোটা দেওয়ালের আড়াল থেকে সুইচ টিপে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করা হবে। শান্তনু সর্বদাই আমাদের এই বিষয়ে এতরকম জ্ঞান দেবার চেষ্টা করে থাকে যে, মনে হয় স্কুল ফাইনাল দেবার আগেই পিএইচ ডি থিসিসটা রেডি করে ফেলেছে। তবে ও যে ঐ বোর্ডে ছবিগুলো এঁকেছে-নানারকম পরমাণু, কোনটার নিউক্লিয়াস ঘিরে একটা ইলেকট্রন ঘুরছে, কোনোটার ষোলটা, কোনটার সাতানব্বই, সে তো ওই ইলেকট্রনের কক্ষপথ গুনেই বলা যাবে কোনটা হিলিয়ম, কোনটা হাইড্রোজেন, কোনটা সোডিয়াম। এর মধ্যে আর নতুন কী আছে! এ সব তো যে-কোন ক্লাস টেনের ছেলের জানা।
শান্তনু কি তাহলে নতুন কোন আইসোটোপ বার করার ফন্দি আঁটছে? আইসোটোপ কাকে বলে, আমরাও একটু আধটু বুঝি। রেডিওঅ্যাকটিভ আইসোটোপ অনেক কাজে লাগে। সেবারে কোত্থেকে এক হোমরা চোমরা এসেছিলেন মেসোমশাইদের প্রোজেক্ট দেখতে। তাঁদের মধ্যে একজন সবজান্তার মত মন্তব্য করেছিলেন, এই যে আপনারা এখানে আইসোটোপ বানাচ্ছেন, এগুলো বিদেশ থেকে আনা মানে ইম্পোর্টেড আইসোটোপের চেয়ে ভালো তো? শুনে প্রোজেক্টশুদ্ধু লোকে বহু কষ্টে হাসি চেপেছিল।
শান্তনু খুব গম্ভীর মুখ করে খাতা থেকে চোখ তুলল। তারপর পেন্সিল দিয়ে মাথার খুলিটা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “দ্যাখ বুবলু, সমস্ত আবিষ্কারই আসলে খুব সহজ। মাধ্যাকর্ষণ যেমন। গাছ থেকে আপেল নীচে পড়বে, এ তো সহজ কথা। সহজ বলেই তো শক্ত রে। তোর কি কোনদিন মাথায় আসত যে পৃথিবী আপেলকে টানছে? তোর মাথায় তো আসতই না। তবে আমার কথা আলাদা। কলম্বাসের ব্যাপারটা দেখ। আমেরিকা আবিষ্কার-ফাটাফাটি কান্ড। কলম্বাসের খাতির দেখে দেশের সবাই জ্বলে পুড়ে মরছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কলম্বাস ভাবলেন, এদের একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার। উনি একটা সেদ্ধ ডিম নিয়ে বললেন-”
“কথা নেই, বার্তা নেই সেদ্ধ ডিম আবার কোথা থেকে এল?”
“আকাশ থেকে পড়ল। ও’রা তখন খেতে বসেছেন রে গাধা। বিরাট ভোজসভা, অনেক মান্যগণ্য লোক। কলম্বাস তাঁদের একটি সেদ্ধ ডিম দেখিয়ে বললেন, এটা আপনারা কেউ দাঁড় করান তো দেখি। কিন্তু ডিম কি কখনও দাঁড় করানো যায়? কেউ পারছেন না দেখে কলম্বাস বললেন, “তাহলে আমি করে দেখাই, আপনারা সব দেখুন।” এই বলে উনি ছুরি দিয়ে ডিমের তলার খানিকটা উড়িয়ে দিলেন। তলাটা চ্যাপ্টা হয়ে গেল। তখন ডিম ঠিকই দাঁড়াল। সবাই বলে উঠলেন, “এ আর কী, এ তো সকলেই পারে।” কলম্বাস গোঁফে তা দিয়ে বললেন, “পারেন নিশ্চয়ই, কিন্তু আমার আগে আর কেউ পেরেছিলেন কি?”
আমি বললাম, “তুই নিজেকে কলম্বাসের সঙ্গে তুলনা করছিস। তা ভাল। কিন্তু আবিষ্কার না হতেই কলম্বাস। তুই তো দেখছি কলম্বাসের বাবা হয়ে গেলি।”
শান্তনু আমার কথায় কর্ণপাত না করে বলল, “ঐ কালো, মোটা ফিজিক্স বইটার একশো তেত্রিশ পাতা খোল। কী দেখছিস?”
“চিত্র নম্বর একুশ পয়েন্ট তিন। পর্যায় সারণী।”
“বুঝলি কিছু? ভাল করে পড়ে দেখ। বোঝাবার চেষ্টা কর।”
চেষ্টা করলাম। পাতা জুড়ে চৌখুপি ঘর কটা, প্রত্যেকটা ঘরের মাঝখানে দুটো করে ইংরিজী অক্ষর, তাদের মাথার ওপরে, নীচে, ডান দিকে খুদি-খুদি করে লেখা কিছু সংখ্যা। ইংরিজী অক্ষরগুলো বুঝতে পারলাম মৌলের রাসায়নিক সংকেত, যেমন এইচ মানে হাইড্রোজেন, এম জি মানে ম্যাগনেসিয়ম, কিন্তু সংখ্যাগুলো কী?”
শান্তনু ততক্ষণে অঙ্ক-স্যারের কায়দায় বোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে। “তুই জিজ্ঞেস করছিলি কী এঁকেছি, তাই না?”
“জানি, জানি। এঁকেছিস পরমাণুর চেহারা। মাঝখানে নিউক্লিয়াস, বাইরে ইলেকট্রন ঘুরছে।”
“রাইট। এখন চার্টের দিকে তাকা, হিলিয়মের পরমাণুর কেন্দ্রে আছে দুটো প্রোটন, দুটো নিউট্রন, বাইরে দুটো ইলেকট্রন। চৌকো ঘরগুলোর নীচের বাঁদিকে দেওয়া আছে পরমাণুসংখ্যা, মানে ইলেকট্রন প্রোটন সংখ্যা। যতগুলো ইলেকট্রন থাকবে, ততগুলো প্রোটন। চার্টের তলার দিকে চলে যায়। মাঝখানে এই ‘এ ইউ’টা কিসের সংকেত জানিস?”
“জানি। সোনার।”
“বাঃ, কিছু জানিস তাহলে। সোনায় প্রোটন, ইলেকট্রন সংখ্যা কত দেখছিস?”
“ঊনআশি।”
“আচ্ছা। সীসে অর্থাত্ লেড-এর ইলেকট্রন প্রোটন কতগুলো?”
“সীসে মানে পি বি। কোথায় গেল? হ্যাঁ, এই তো, বিরাশি।”
“তাহলে তফাত কত?”
“কিসের তফাত?”
“বিরাশির সঙ্গে উনআশির?”
তত্ক্ষণাত্ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে গেছি। আমি হতভম্ভ হয়ে বললাম, “শান্তনু, তুই যে সেকালের অ্যালকেমিস্ট হয়ে গেলি! তুই ভাবছিস শস্তা ধাতুর প্রোটন, ইলেকট্রন কমিয়ে তাকে সোনায় পরিণত করবি?”
অ্যালকেমিস্ট বলাতে ক্ষেপে লাল হয়ে গেল শান্তনু। চেঁচিয়ে উঠে বলল, অ্যালকেমিস্ট! অ্যালকেমিস্টরা না-জানত ফিজিক্স, না-জানত কেমিস্ট্রি। ওরা কেবল বিশ্বাস করত বস্তুর রূপান্তর ঘটানো যায়। আর কিছু জানত না। বিশ্বাসে ভেলকি দেখানো যায়, বিশ্বাস দিয়ে সায়েন্স হয় না, বুঝলি? ওরা মনে করত এলোপাথাড়ি পরীক্ষা করতে করতে ওরা ঠিক বেস্ মেটালকে সোনায় বদলাতে পারবে। এই মনে করে তারা এটার সঙ্গে ওটা মেশাত, জলে গুলত, আগুন ফোটাত, ঠাণ্ডা করত- পাথর, ধাতু, তরল, দ্রবণ, সব রকম জিনিস নিয়ে দেখত কিসের সঙ্গে কী যোগ করলে সীসে বদলে হয়ে যাবে সোনা। কেউ কি করতে পেরেছিল? পারেনি। তার কারণ ওরা পদার্থের আসল গঠনটাই জানত না-পারমাণবিক গঠন। এটা জানত না যে, আগুনে ফোটালে কিংবা জলে ভেজালে পারমাণবিক বিক্রিয়া হবে না। তার জন্যে চাই দারুণ পাওয়ারফুল অ্যাকসেলারেটর।”
“কত পাওয়ার ফুল?” ামি ভয়ে ভয়ে জিগেস করলাম।
“ধরে নে একশো মিলিয়ন ভোল্ট। এটার জন্য আর-একটু অঙ্ক কষতে হবে।”
আমি আস্তে আস্তে বললাম, “শান্তনু, তুই যা ভাবছিস, তা অসম্ভব। মেসোমশাইদের অ্যাকসেলারেটরে এই সব ছেলেখেলা তোকে করতে অ্যালাউ করবে ওরা?”
“ছেলেখেলা নয়। আমি অনেক ভেবেছি। বাবার সঙ্গে অবশ্য এ-বিষয়ে এখনও কথা হয়নি। কষে দেখতে হবে ঠিক কত জোরে হিট করলে তিনটে প্রোটন ছিটকে বেরিয়ে আসবে-তারপরে অবশ্য বেরিয়ে আসা প্রোটন নিয়ে অন্য সমস্যা আছে, সেটার একটা সমাধান বার করতে হবে।”
আমি বললাম, “শান্তনু, সোনা বানানো যদি এতই সহজ, তাহলে এতদিন সব পরমাণু-বিজ্ঞানীরা করছিল কী?”
“ওদের কি কোন প্র্যাকটিকাল বুদ্ধি থাকে? একমাত্র এডিসন ছাড়া আর কোন প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধিওয়ালা সায়েন্টিস্ট দেখেছিস তুই?”
“দুঃখের বিষয় এডিসনকেও আমি দেখিনি।” আমি উঠে পড়লাম। কচুরিগুলি শেষ হয়ে গিয়েছিল। আঙুল চাটতে-চাটতে বললাম, “চা’টা তুই-ই খেয়ে নে।”
*************
চেয়ারে বসে-বসেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। তখন নিশ্চয়ই অনেক রাত। সবাই শুয়ে টুয়ে পড়েছে। নিঝুম রাতে হঠাত্ শুনলাম দমকলের আওয়াজ, তারপরেই টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং, প্রায় একই সঙ্গে সাইরেনের ভোঁ। তারপরেই শুনলাম রেডিওতে খবর পড়া হচ্ছে-কাল মধ্য রাত্রে একটি বাড়ি রহস্যজনক বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ কেউ হতাহত হয়েছেন বলে শোনা যায়নি তবে…ধুপধাপ শব্দ, অনেক লোকের চলাফেরা, উত্তেজিত কথাবার্তা। ঘুমের মধ্যেই আমি ভাবলাম, আরো যাও সীসের প্রোটন আলাদা করতে। সোনা করার চেষ্টা। এখন হল তো? খুব শিক্ষা হল শান্তনুচন্দ্রের।
স্বপ্নের কথা ঘুম ভেঙে গেলে মনে থাকে না, কিন্তু কাল রাত্রের ব্যাপারটা এত সত্যি বলে মনে হচ্ছিল যে, সকালবেলা ভয়-ভয় করতে লাগল। সত্যিই কিছু হল নাকি? খবরের কাগজটা আসতে এত দেরি করে। এলেও কি সেটা আমার হাতে সহজে পৌঁছয়? কী করি?
একটা খাতা আনবার নাম করে বেরিয়ে পড়লাম। গিয়ে দেখি মেসোমশাই অফিসে যাবার জন্যে রেডি হচ্ছেন। এই সময়টা ভীষণ তাড়াহুড়ো, কোন জিনিস সামনে থাকলেও খুঁজে পাওয়া যায় না, বাড়িসুদ্ধ সবাই ওঁর কাছে বিনা কারণে বকুনি খায়। আমি কোনমতে অদৃশ্য থাকার চেষ্টা করতে-করতে সুট করে শান্তনুর ঘরে গিয়ে ঢুকেছি।
ঢুকে দেখি বোর্ড পরিষ্কার। টেবিল থেকে সব কালো মোটা বই উধাও। শান্তনু লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে।
“এ কী, তুই এখনো ঘুমোচ্ছিস, এটা কি কলম্বাসের বাবার উপযুক্ত কাজ?”
শান্তনু চোখ খুলল। খুলেই আবার ঘুমোবার জন্যে পাশ ফিরল।
“তোর এক্সপেরিমেন্ট ফুটে গেল নাকি?”
এতক্ষণে জেগে ওঠার লক্ষণ দেখা গেল। সান্তনু উঠে বসল। বলল, “বাবা বললেন, আইডিয়াটা খুব নতুন। হিসেবেও কোন ভুল নেই। কিন্তু অত জোরে হিট কার জন্যে যে অ্যাকসেলারেটর চাই সেটা হতে হবে অন্তত দেড় কিলোমিটার লম্বা। তাছাড়া তৈরী করতেও খরচ পড়বে তিরিশ পঁয়ত্রিশ কোটি টাকা। বানাতেও লাগবে কমসে কম দশ বছর। তার মধ্যে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে বাড়তে টোটাল খরচা চল্লিশ কোটিতে গিয়ে ঠেকতেও পারে। বাবা বললেন, অত কাণ্ড করে শস্তা মেটালকে সোনা বানাতে যা খরচ পড়বে, তাতে নকল সোনাই হয়ে যাবে আসল সোনার চেয়ে দামী।”
“আমারও তাই মনে হয়েছিল।” আমি গম্ভীরভাবে বললাম।
শান্তনু বিছানা থেকে ওঠবার উপক্রম করতেই আমি এক লাফে দরজার বাইরে। যাবার আগে গলাটা বার করে ঘোষণা করে গেলাম, “তাহলে আজ বিকেলে তুই খেলছিস। যাই, কেষ্টাদের বলে আসি।”

Share This:

Post Tags:

Jyoti Sing

I'm Jyoti Sing. A full time web designer. I enjoy to make modern template. I love create blogger template and write about web design, blogger. Now I'm working with Themeforest. You can buy our templates from Themeforest.

  • To add an Emoticons Show Icons
  • To add code Use [pre]code here[/pre]
  • To add an Image Use [img]IMAGE-URL-HERE[/img]
  • To add Youtube video just paste a video link like http://www.youtube.com/watch?v=0x_gnfpL3RM