News Ticker

Menu

চেকমেট

চেকমেট

নির্মাল্য সেনগুপ্ত


শীতকালটা আমার বরাবরই ভাল লাগে। ঘাম হয় না, ফ্যান লাগে না, সোয়েটার চাপিয়ে উত্তাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কমলালেবু খাওয়া যায়। লেপের তলায় ঘুমনোর কথা তো বাদই দিলাম। সবচেয়ে বড় কথা, সহজে মাথা গরম হয় না। তবে শীতকালের দোষ একটাই। মেয়েরা বড় ঢাকাঢাকি দিয়ে ঘোরাফেরা করে, না হলে বোধ হয় বুকে কফ জমে যায়। এদিক থেকে বর্ষাকালটা মন্দ নয়। কোচিং থেকে ফেরার সময় ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামলে… আহা, সিক্ত বসনে নারী! অমন আরাম লেপের তলাতেও নেই।
এসব ভাললাগার কথা ভাবতে-ভাবতে ডিম কিনতে চলেছি। তিনঘর মেপে কোনাকুনি হাতির মতো দুলকি চালে যেই দোকানের দিকে পা বাড়িয়েছি, অমনি আবিরদা ডাক দিল, “অ্যাই, রাজা, শোন এদিকে।”
“হ্যাঁ, আবিরদা, বলো।”
“তোর কাজটা হয়ে গিয়েছে রে। আজ সন্ধে সাতটার সময় তোকে কিংশুক ডেকেছে। চলে যাস। একমিনিটও দেরি করবিনা কিন্তু। কিংশুক ভীষণ পাংচুয়াল।”
আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। এতদিনে তবে চিঁড়ে ভিজল। গদগদ হয়ে বললাম, “নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! বাড়িতে ডেকেছে?”
“না, ক্লাবে। ৬৪ নম্বরে। চিনিস তো?”
“তা আর চিনিনা! থ্যাঙ্ক ইউ, আবিরদা, থ্যাঙ্ক ইউ!”
“যা যা, আর ন্যাকামো করতে হবে না! ফেরার সময় হরিদাকে চায়ের দামটা দিয়ে যাস। ১৭ টাকা। শালা, মানিব্যাগটা নিয়ে বেরতে ভুলে গিয়েছি।”
হুম! সেয়ানা দ্য গ্রেট। তবে সস্তাই পড়ল। ১৭ টাকা। মন্দ নয়!
 || ২ ||
আমি রাজা। ভাল নাম অধিরাজ নন্দী। প্রচণ্ড রোগা আর ক্যাবলা টাইপের দেখতে একটা ছেলে। প্রথম-প্রথম আমি তা মোটেই বিশ্বাস করতাম না আর প্রাণপণে আয়না দেখে মুগ্ধ হতাম। কিন্তু একজন এমনভাবে আমাকে কথাটা বলেছিল যে, তারপর থেকে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে যায়, আমি ক্যাবলা আর রোগা! তাই যে-কোনও ইন্ট্রোডাকশনে আমি এটাই নিজের পরিচয় হিসেবে দিই।
এর পিছনের ঘটনাটা বেশ জটিল। আমার একটা রোগ আছে। রোগটার নাম এইচডি। না, হাই ডেফিনিশন নয়, এটার ফুলফর্ম, হান্টিংটন ডিজ়িজ়। ভীষণ খটোমটো শোনালেও এর মানেটা খুব সোজা। এটা একটা প্যারাসাইকিক রোগ, যার জন্য ছোটবেলায় অতিরিক্ত শাসন বা বদ আহ্লাদের ফলে যে-কোনও সামান্য বিষয়ে মস্তিষ্কে প্রবল অ্যাড্রেনালিন ক্ষরণ ঘটে এবং সেই ফল মারাত্মক হতে পারে। পাতি বাংলায়, আমি রেগে গেলে হুঁশ হারিয়ে ফেলি আর কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে দিই।
প্রথম সিমটম ধরা পড়ে যখন ক্লাস এইটে পড়ি। পেনসিল কাটার দিচ্ছিল
না বলে একটা বন্ধুর নাকে মুগ্ধবোধ বসিয়ে দিই! এরপর থেকে যখন আস্তে-আস্তে বিভিন্ন শিকারের দাঁত, থুতনি, হাত-পা আর গোছা-গোছা মাথার চুল সংগ্রহে আনতে শুরু করেছি আর আমার বাবা লক্ষ-লক্ষ অভিভাবকের শাপ-শাপান্তে জেরবার হয়ে পড়েছেন, তিনি আমাকে মানসিক ডাক্তার, মানে, সাইকায়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যান। লোকে আমায় পিছনে ‘পাগল’ বলতে শুরু করে। যেহেতু ছোটবেলায় কেউই আমাকে অতিরিক্ত শাসন আর বদ আহ্লাদ দেয়নি, ডাক্তার কনক্লুশনে আসেন যে, এই রোগটি জেনেটিক। এরপর বাবা স্বীকার করেন যে, আমার প্রপিতামহরও নাকি এর কাছাকাছি কিছু একটা ছিল। ডাক্তার আমায় ওষুধ হিসেবে দেন মেডিটেশন, ধ্যান, যোগগুরুর অনুলোম-বিলোম অথবা এমন কিছু যার পিছনে বুদ্ধি খাটাতে হয় এবং ধৈর্য বাড়ে। এর পর থেকেই আমার সাদাকালো জীবনের শুরু।
দাবা, ওষুধ হিসেবে বাবা আমাকে দাবা খেলা শেখান। আস্তে-আস্তে খেলাটার প্রতি আমার ভালবাসাও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। এইচডি-র প্রভাবও একদম কেটে যায়। প্রথম-প্রথম বাবার সঙ্গেই খেলতাম। কিন্তু মাসদুয়েক পর বুঝি, তিনি মোটেও ভাল খেলোয়াড় নন। কারণ, তিনি রোজই হারছেন এবং দিনে-দিনে তাঁকে হারানোর দানের সংখ্যাও কমে আসছে। বাবাও বেশ লজ্জিত হচ্ছেন এবং মীমাংসা হিসেবে সেই জিনকেই দোষারোপ করছেন। আমার ঠাকুরদা নাকি দাবাতে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। ভেবেছিলাম বলি, ‘সব জিনগুলোই তোমাকে টপকে গিয়েছে কেন, বাবা?’ তারপর ভাবলাম, ‘নাহ্। অ্যাক্সিডেন্টালি যদি এইচডি-র জিন এই মুহূর্তে তাঁর মধ্যে প্রকট হয়ে পড়ে? দরকার নেই!’
যাই হোক, খেলাটার প্রতি ভীষণ ভালবাসা হওয়ায় আমার লক্ষ্য অনেক বেড়ে যায়। বিশ্বনাথন আনন্দ, সূর্যশেখর গঙ্গোপাধ্যায়, ইত্যাদি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। তার জন্য দরকার ছিল সঠিক প্রশিক্ষণ। যা আমি পেতাম ‘চেকমেট’-এ।
চেকমেট একটা চেস ক্লাব। কলকাতার সবচেয়ে বড়, এবং ভারতের মধ্যে প্রথম দশটি চেস ক্লাবের মধ্যে একটা। প্রতি বছর ঠিক ষোলোজন করে এই স্কুল বা ক্লাবে সুযোগ পায়। দু’বছরের কোর্স। মোট বত্রিশজন ছাত্র-ছাত্রী। জুনিয়র ষোলোজন বোড়ে বা পেয়াদা আর সিনিয়ররা বড়-বড় হাতি-ঘোড়া! এদের কিং হল, কিংশুক মুখোপাধ্যায়। যার অল ইন্ডিয়া র্যাঙ্ক হল ২৬।
সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রতিবছর কলকাতায় প্রচুর ছেলেমেয়ে আসে। সুযোগ পায় মাত্র ষোলোজন। হ্যাঁ, অবাক লাগলেও ক্রিকেট-ফুটবলের ভারতে এখনও দাবাপ্রেমিক আছে কিছু।
চেকমেটে সুযোগ পেতে হলে একটাই পরীক্ষা। তা হল, কিংশুকদার সঙ্গে খেলা। যে যত বেশি দান পর্যন্ত যেতে পারে। প্রথম বছর মাত্র একুশ দানে আমি হেরে যাই। আমার পরে বহু ছেলেমেয়ে থাকলেও, আগে ষোলোজন ছিল। কিন্তু গতবারের ঘটনা এখনও ভাবলে আমার সেই পুরনো রোগটা আবার ফিরব-ফিরব করে।
সেবার অনেক প্র্যাকটিস করে গিয়েছিলাম। খেলেওছিলাম ভাল। একবার তো কিংশুকদাকে প্রায় তিনমিনিট ধরে ভাবতে হয়েছিল পরের দান দিতে। আমাকে হারাতে প্রায় ৪২ দান লেগেছিল। আমি শিয়োর ছিলাম এবার সুযোগ পাব। খেলা শেষ হতে চার্টে দেখলাম, আমি চোদ্দো নম্বরে আছি। আমার পরে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে, যাদের দানসংখ্যা ৩৯ ও ৩৭। ফাইনাল চার্টে আমার নাম ছিল না!
প্রচণ্ড প্রতিবাদ নিয়ে যাওয়ার পর শুনি, আমার পরে আরও দু’জন খেলেছিল, যাদের দানসংখ্যা আমার চেয়ে বেশি ছিল। তারাই চান্স পেয়েছে। কিন্তু সঙ্গে ঢুকেছে আমার পরে থাকা সেই দু’জন ছেলেমেয়েও। সেই ছেলেটার বাবা কীসব এমএলএ-টেমেলে হওয়ায় তাকে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। তা মানলাম। কিন্তু মেয়েটা? সে আবার কোন মিনিস্টারের মেয়ে? দেখেছিলাম, ক্লাবের দরজায় দাঁড়িয়ে একটা কালো রঙের জিন্সের উপর সাদা টপ আর সবুজ ব্যান্ড দিয়ে ঝঁুটি-বাঁধা ফরসা করে একটা মেয়ে কিংশুকদার সঙ্গে বেশ হেসে-হেসে কথা বলছে। কিংশুকদাও দিব্যি হাত-মুখ নাড়িয়ে তার চালের
প্রশংসা করছে।
আমি সহ্য করতে পারিনি। সটান গিয়ে বলেছিলাম, “এটা কী হল? ওর থেকে আমার দান পাঁচটা বেশি ছিল। তাও আমি নই, ও কেন?”
দু’জনই ভীষণ বিরক্তির সঙ্গে আমার দিকে তাকায়। প্রেমালাপে বাধা দেওয়ার জন্যই হয়তো।
কিংশুকদা আমায় বুঝিয়ে দেয়, দাবা খেলাটা মস্তানির জিনিস নয়। অনেক ধৈর্য লাগে। আমার যে সেটা নেই, তা নাকি সে প্রথম দর্শনেই বুঝে গিয়েছিল এবং ভবিষ্যতেও যেন আমি চেকমেটে ঢোকার কথা স্বপ্নেও না ভাবি। ভাবলেও যে খুব একটা লাভ হবে না, তাও জানিয়ে রাখে কিংশুকদা। আমার মাথার ভূতটা লাফাচ্ছিল। বহুদিন বাদে ফেটে বেরনোর জন্য ছটফট করছিল। কোনওমতে নিজেকে সামলে বেরিয়ে এসেছিলাম।
গেটের মুখে কেউ আমাকে ডেকেছিল, “এই যে, শোনো?”
তাকিয়ে দেখি সেই ঝুঁটিওয়ালা মেয়েটা। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, “কী?”
“কিংশুকদা ভুল বলেছে। আমি ওর হয়ে সরি বলছি।”
যাক, মেয়েটা ভদ্র। ভূতটা একটু শান্ত হয়েছিল। বলেছিলাম, “ইট্স ওকে।”
তারপরই মেয়েটা বলেছিল, “আসলে তোমার মতো রোগা ছেলেরা মস্তান হতে পারেনা। আর দাবা? এসব বুদ্ধিমানদের খেলা। কেন সময় নষ্ট করছ? চলি,”একটু এগিয়ে গিয়ে মেয়েটা একবার পিছনে ফিরে তাকিয়েছিল। তারপর আস্তে করে “ক্যাবলা কোথাকার!” বলে ভিতরে চলে গিয়েছিল।
বোকার মতো গেটটা ধরে দাঁড়িয়ে মেয়েটার চলে যাওয়া দেখেছিলাম। ওর ঝুঁটির শেষপ্রান্ত চোখের নাগাল থেকে
বেরিয়ে গেলে মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এসেছিল, “চেক…”
|| ৩ ||
বছর ঘুরে গিয়েছে। আমি কিন্তু হিন্দি সিনেমার পরাজিত নায়কদের মতো খেলা থামাইনি। আরও বেশি-বেশি করে খেলেছি। যে-ই বাড়িতে আসে, ঘাড় ধরে বোর্ডের উলটোদিকে বসিয়ে দিই। ডজনখানেক বই কিনেছি। কিন্তু চেকমেটে ঢুকতে না পারার আফসোস থেকেই গিয়েছিল। এমন সময় একদিন জানতে পারলাম, আমার পাড়ার আবিরদা আর কিংশুকদার গলায়-গলায় বন্ধুত্ব। ব্যস! ঝুলে পড়লাম আবিরদার গলায়। ১৭ টাকার বিনিময়ে আবিরদা, কিংশুকদার রাগ ভাঙাল। অবশেষে আজ আমার সামনে  এল সুযোগ।
সন্ধে সাতটা। পৌঁছে গিয়েছি ৬৪ নম্বরে। বেল বাজাতে কিংশুকদা এসে দরজা খুলল,
“আয়।”
ক্লাবের মেঝেটা দাবার ঘরের মতো সাদা-কালো ছক কাটা। দু’দিক মিলিয়ে একত্রিশজন ছেলেমেয়ে। একদিকে নৌকোর সামনে বোড়ের ঘরটা ফাঁকা। আড়চোখে দেখলাম, তার উলটোদিকে মন্ত্রীর ঘরে সেই ঝুঁটি-বাঁধা মেয়েটা একটা নীল চুড়িদার পরে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। আমি জড়সড় হয়ে কিংশুকদার সামনের চেয়ারটায় বসলাম। মাঝে একটা টি টেব্ল। তার উপরে একটা ক্রিস্ট্যালের বোর্ডে গুটি সাজানো।
কিংশুকদা বলল, “দ্যাখ, এবছরের ষোলোজন ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু দু’জন পরে চাপ সামলাতে না পেরে পালিয়ে যায়। এমনিতেই চেকমেটে ঢোকার জন্য প্রচুর ছেলেমেয়ে আসে। একজনকে পেয়ে গিয়েছি। আবির বলল বলে তোকে একটা চান্স দিলাম। তবে তার জন্য তোকে খেলতে হবে আর অন্তত ষাট দান পর্যন্ত টিকতে হবে।”
মাথায় বাজ পড়ল আমার! ২৬ র্যাঙ্ক হোল্ডারের সঙ্গে ষাটটা দান টেকা? ওহ্! এই বছর তো শুনলাম, কিংশুকদা আবার ২১ নম্বর হয়েছে। ঘরের মধ্যে চাপা গুঞ্জন চলছে। হাসাহাসিও বোধ হয়। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, কিংশুকদা আমাকে ভাগানোর জন্যই এই পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করেছে। করুণ চোখে তাকিয়ে দেখলাম, ঝঁুটি-বাঁধা মেয়েটা, পাশের চশমা পরা রজনীকান্তের মতো দেখতে ছেলেটার ঘাড়ে হাত রেখে দাঁত বের করে হাসছে। ইশ্, কেন যে এলাম! অপমানিত তো হবই, তারউপর ১৭ টাকার শোক!
খেলা শুরু হল।
|| ৪ ||
“রাজা, এদিকে আয়।”
“আসছি, কিংশুকদা।”
“এই নে, চারটে ফর্ম। তোর কাছে রেখে দে। প্রথম চারজনকে দিয়ে দিবি সময়মতো। আর মনে করে ষোলো তারিখের আগে একসঙ্গে চারটে আমার কাছে জমা করবি। ঠিক আছে?”
“আচ্ছা।”
কিংশুকদা চলে গেল। আমি চারটে ফর্মের দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে রইলাম। ‘অল ইন্ডিয়া চেস টুর্নামেন্ট’-এর ফর্ম। প্রতিবছর চেকমেট থেকে চারজন প্রতিযোগী যায় এই টুর্নামেন্টে। গতবছর কিংশুকদা ছাড়াও চেকমেটের অনীকদা নামের একজন প্রথম পঞ্চাশজনের মধ্যে ছিল। আমি যদি প্রথম চারজনের মধ্যে পৌঁছতে পারি, চেকমেটের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও জুনিয়র এই টুর্নামেন্টে যাবে।
হ্যাঁ, আমি এখন চেকমেটের একজন সদস্য! প্রথম বছর শেষ হতে চলল। অবিশ্বাস্য হলেও সেদিন কিংশুকদার সঙ্গে আমি ৭৮ দান পযর্ন্ত টিকেছিলাম। আর আমার সবচেয়ে বড় অ্যাচিভমেন্ট ছিল, আমি এক্সচেঞ্জ না করে কিংশুকদার মন্ত্রী খেতে পেরেছিলাম, যা খুব কম লোকই পারে। যদিও মেট হওয়ার আগে আমার শুধু একটা নৌকো আর একটা বোড়ে ছিল, রাজা ছাড়া। খেলার পর কিংশুকদা আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়েছিল। এমনকী, আমাকে সূর্যশেখর গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলনা করেছিল।
চেকমেটের নিয়ম হল, অল ইন্ডিয়া চেস টুর্নামেন্টের আগে চেকমেটের বত্রিশজনের মধ্যে একটা টুর্নামেন্ট হয়। তার থেকে প্রথম চারজন অল ইন্ডিয়া চেস টুর্নামেন্টের ফর্ম পায়। আগামিকাল থেকে সেই খেলা শুরু।
আমার খ্যাতি চেকমেটের বাকিরা মোটেও ভাল চোখে দেখছেনা। মঞ্জুলা তো নয়ই। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছি, ওই ঝুঁটি-বাঁধা মেয়েটির নাম হল মঞ্জুলা। প্রথমদিনই খেলার শেষে আমার সামনে আসে। আমি হকচকিয়ে যাই। এসেই প্রশ্নবাণ ছুড়ে দেয়,
“নিজেকে খুব বড় দাবাড়ু ভাবছ? একটা সহজ প্রশ্নের উত্তর দাও দেখি। ‘চেকমেট’-এর বাংলা কী?”
সেরেছে! এ কী প্রশ্ন? আমি উত্তর হাতড়াই।
“জানো না তো? এক্সপেক্টেড! আগে জানো, তারপর নিজেকে দাবাড়ু ভাববে,” বলেছিল মঞ্জুলা।
আমি লজ্জাবতী লতার মতো কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। জায়গাটা মোটেও সুবিধের নয়। এখানে প্রচুর দাম্ভিক ছেলেপুলে রয়েছে। তনয়, বিকাশ, জয়ন্ত ইত্যাদির সঙ্গে অনিরুদ্ধ এবং মঞ্জুলা একটা গ্রুপ বানিয়েছে। চেকমেটের বেস্ট প্লেয়ার অনিরুদ্ধ। এরা সকলেই ভাল খেলে এবং তার সঙ্গে ভয়ানক অহংকার রোগে ভোগে। সবচেয়ে গা-জ্বালানি ওই মঞ্জুলা। চেকমেটের ক্লাসে সকলের সঙ্গেই আমি খেলেছি। শুধু ওর সঙ্গে ছাড়া। অনিরুদ্ধটা তো ওর একেবারে ন্যাওটা। ঘোঁতঘোঁত করে হাসে আর মঞ্জুলার কথায় সায় দেয়। আর
মাঝেমধ্যেই আমার পিছনে লাগে। কয়েকদিন আগে কিংশুকদা একবার মঞ্জুলার সঙ্গে আমার খেলা ফেলেছিল, কিন্তু আমিই রাজি হইনি।
“হুম, সমঝা,” বলে একচোট হেসেছিল ও। সেই কথাটা পরে সকলের কানে যায়। তারপর থেকেই এরা আমার সঙ্গে খুব একটা কথা বলছে না। যা বলার সব ইনডাইরেক্টলি। আমিও সাবধানে থাকছি। এদের কথায় মোটেও কান দিচ্ছি না। সেই ভূতটা ঘুমন্ত হলেও আছে তো!
ইন্টার চেকমেট টুর্নামেন্ট শুরু হল। পুরোটাই নক আউট। প্রথম ষোলোজন, জুনিয়রদের মধ্যে থেকে আটজন আর সিনিয়রদের থেকে আটজন উঠবে। এরপর আর সিনিয়র-জুনিয়র মানা হবেনা। ফিক্সচার অনুযায়ী খেলা চলবে। তারপর কোয়ার্টার, সেমি আর ফাইনাল। বিজয়ীর সঙ্গে খেলা হবে কিংশুকদার।
প্রথম রাউন্ডে আমি সহজেই জিতে প্রথম ষোলোজনে গেলাম। পরের খেলা সিনিয়র বিজেনদার সঙ্গে। বিজেনদার খেলার ছক হল, প্রচণ্ড খাওয়াখাওয়ি করা। মন্ত্রী, ঘোড়া, হাতি সব এক্সচেঞ্জ হয়ে যায়। শেষে বোড়ে ঠেলে মন্ত্রী বানিয়ে মেট করে। আমার
সঙ্গে সেই চাল চললনা। খেতে-খেতে হঠাত্‌ ঘোড়ার একটা চালে আমার মন্ত্রী খেতে গিয়ে নিজের মন্ত্রী, নৌকো, ঘোড়া তিনটেই খোয়াল। শেষে আমিই বোড়ে নামিয়ে মেট করলাম। উঠে গেলাম কোয়ার্টার ফাইনালে। অন্যদিকে আরও ছ’জনের সঙ্গে খেলে মঞ্জুলাও উঠল শেষ আটে।
ক্লাব থেকে বেরনোর সময় দেখি, মঞ্জুলা অনিরুদ্ধর সঙ্গে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। অনিরুদ্ধ দারুণ খেলে শুনেছি। ও কিংশুকদার প্রিয় ছাত্র ছিল। অনিরুদ্ধ নিজেকে ভীষণ স্মার্ট দেখানোর বৃথা চেষ্টা করছে। আমি পাশ দিয়ে যেতেই মঞ্জুলা জোরে-জোরে বলল, “আচ্ছা, অনিদা, তুমি, তনয় আর বিকাশ তো যাচ্ছ। চার নম্বরে আমি গেলে কেমন হয়?”
অনিরুদ্ধ  যথারীতি ঘোঁতঘোঁত করে হেসে কিছু একটা বলল। আমি উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলাম।
|| ৫ ||
আজ আমার জীবনের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ খেলা। আজ জিতলেই আমি ভারতের সেরাদের মধ্যে গণ্য হব। প্রতিপক্ষে বিকাশ ভাদুড়ি। গতবার জুনিয়র হয়েও শেষ আটে পৌঁছেছিল। এবার আমি পৌঁছনোয় সবচেয়ে বেশি রেগেছে বিকাশই। কারণ, আমি ওর রেকর্ড ভেঙে দিয়েছি! বিকাশের খেলা ভীষণ সূক্ষ্ম। অতি সাধারণ দান দিয়ে প্রতিপক্ষকে শেষ করে দেয়। আমি জানি, নার্ভাস হলে চলবেনা। ধৈর্য চাই, ধৈর্য। হান্টিংটন হটাও, হটাও!
প্রায় দেড়ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। চাল দিচ্ছি আর বোতাম টিপছি। একটা মুভের জন্য বরাদ্দ সময় খুব বেশি হলে পনেরো সেকেন্ড। আমার অবস্থা খুব শোচনীয়। দু’টো নৌকোই গিয়েছে। বোড়ে মাত্র তিনটে। ওদিকে বিকাশ খুইয়েছে মাত্র একটা হাতি আর তিনটে বোড়ে। একের পর-এক তুখোড় চাল দিয়ে চলেছে। আমি বুঝলাম, আমার সময় আসন্ন। তখনই বিকাশ ওর মন্ত্রীটা দিয়ে আমার একটা বোড়ে খেয়ে আমায় চেক দিল, আর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করল।
আমি হাতিটাকে কোনাকুনি রাজার সামনে এনে চেক আটকালাম। এখন ওকে মন্ত্রী বাঁচাতে হবে। বিকাশ ওর মন্ত্রীটাকে দু’ঘর সরিয়ে আমার ঘোড়ার পাশে আনল। পিছনেই ছিল ওর নৌকো। আমি সটান নিয়ে ওর নৌকোটা খেয়ে নিলাম। ওর কাস্লের মধ্যে রাজার পাশে দ্বিতীয় নৌকোটা ছিল। বিকাশ সাততাড়াতাড়ি গিয়ে যেই আমার হাতি খেল, আমি জায়গাটা পেয়ে গেলাম। ঘোড়াটাকে আড়াই ঘর বাড়িয়ে দিলাম। চেক! একদিকে রাজা আর একদিকে মন্ত্রী। বাধ্য হয়ে ওকে রাজা সরাতে হল। আমি মন্ত্রীটাকে গিলে নিলাম। এরপর বিকাশকে মেট করতে আমার বেশি সময় লাগেনি।
সারা চেকমেট আমার জয়জয়কার করছে। প্রথম কোনও জুনিয়র অল ইন্ডিয়া চেস টুর্নামেন্টে যাচ্ছে। কিংশুকদা এসে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুই সত্যিই রাজা সেটা প্রমাণ করে দিলি। তোকে বোড়ে বলে কার ক্ষমতা দেখি!”
আমার চোখ তখন খুঁজছিল কুইনকে। পেলাম। দরজার সামনে সজল চোখে দাঁড়িয়ে রয়েছে মঞ্জুলা। ও হেরে গিয়েছে। প্রথম চারজনের মধ্যে থাকতে পারেনি। আমার কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আমার তো খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু খুশি নয়, আমার তখন কষ্টই হচ্ছিল!
|| ৬ ||
আজ সারাদিন ফর্ম নিয়ে পড়ে আছি। আনন্দের জ্বর সারা বাড়িতেই লেগেছে। বাবা একটা খবরের কাগজ মুখের সামনে নিয়ে নিজের উচ্ছ্বাস লুকোচ্ছেন। আবিরদা সকাল থেকে আমার বড়িতে। মা ডেকেছেন, ওকে পেটপুজো করানোর জন্য। আফটার অল সবকিছু সম্ভব তো হল ওর জন্যই। সেই ১৭ টাকার কথা না হয় বাদই দিলাম। অনেকেই বাড়িতে আসছে অভিনন্দন জানাতে। আমি আবিরদার কানে ফিসফিস করে বলে চলেছি, “আরে, এই কাকিমাটা এসেছে কেন? এর ছেলেকেই তো উইকেটের বাড়ি দিয়ে…”
সেমিফাইনালে আমি হেরে গেলাম অনিরুদ্ধর কাছে। মন-মেজাজ তেমন ভাল নেই। ভেবেছিলাম, টপার হয়ে পুরো চমকে দেব। কিন্তু তা যে একমাত্র শাহরুখ খানের পক্ষেই সম্ভব, ভুলে গিয়েছিলাম। কিংশুকদা খেলার শেষে আমায় ভুল চালগুলো বোঝাল। এছাড়া মন ঠিক করার জন্য বলল, সব জেনে গেলে আর আমি এখানে এসেছি কেন? এখনও তো অনেক শেখার বাকি। পরের বছর আমি টপ করবই।
ক্লাব থেকে বাড়ি ফিরছি। ফর্ম ফিলআপ করার সব নিয়মকানুনগুলো কিংশুকদার কাছ থেকে বুঝে নিয়েছি। এমন সময় একটা চেনা ডাক। মঞ্জুলা হাত বাড়িয়ে বলল,
“কনগ্র্যাট্স।”
এ কী! ভূতের মুখে রামনাম! গদগদ হয়ে বললাম, “থ্যাঙ্ক ইউ! থ্যাঙ্ক ইউ! তোমার জন্য সরি। পরের বার নিশ্চয়ই পারবে, দেখে নিয়ো।”
মঞ্জুলা মাথা নিচু করে বলল, “ভুলে যাচ্ছ, আমি তোমার সিনিয়র। দু’বছরের কোর্সে এটাই আমার ফাইনাল ইয়ার। খুব আশা ছিল, এবার পারব। একদিন আমার সঙ্গে খেলে দেখো, আমি খুব একটা খারাপ খেলিনা।”
আমি দেখলাম, মঞ্জুলার চোখে প্লাবন আসছে। এদিকে সুনামিটা টের পাচ্ছি অন্য কোথাও। “আর হয়তো দেখা হবে না। ভাল থেকো, ভাল করে খেলো। বাই।”
আমার প্রায় দু’বছর আগের একটা সন্ধের কথা মনে পড়ছিল। সেই প্রথমদিন। সেই সবুজ ব্যান্ড পরা ঝুঁটি আস্তে-আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার… আবার! আর না! আমি সেই মুহূর্তে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেললাম। দৌড়ে গেলাম মঞ্জুলার কাছে। ওকে অবাক করে হাঁপাতে-হাঁপাতে হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, “এই নাও।”
মঞ্জুলা চোখ ছানাবড়া করে ফেলল। আমার হাতে অল ইন্ডিয়া চেস টুর্নামেন্টের ফর্ম।
“মানে?”
“আমার তো এখনও একবছর সুযোগ আছে।  আমি জানি পরের বছর আমি আবার পাব। তুমি এই বছর যাও, প্লিজ়!”
মঞ্জুলা হেসে আমার হাত থেকে ফর্মটা নিয়ে বলল, “তোমায় একটা প্রশ্ন করেছিলাম, মনে আছে?”
“প্রশ্ন? কোন প্রশ্ন?”
“চেকমেটের বাংলা কী?”
মেয়েটা পুরো পাগল! গত একবছরে আমি এটা মনে করে জেনে উঠতে পারলাম না? ফের আমতা-আমতা করতে শুরু করলাম।
হঠাত্‌ মঞ্জুলা আমার হাতটা ধরল। আমার সারা শরীরে তখন সিইএসসি দৌড়চ্ছে। হাতটাকে সামনে তুলে ধরে ফর্মটা গুঁজে দিয়ে বলল, “আই ওয়াজ় রাইট। তুমি ভাল দাবাড়ু নও। এমন করলে জিততে পারবেনা। মানেটা জেনে এসো। বাই।”
আমি অন্ধকার পায়ের নিচে এক হাঁটু কলকাতা নিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কানের পাশে কে যেন চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে বলল, ‘রোগাপানা ক্যাবলা, রোগাপানা ক্যাবলা…’
|| ৭ ||
আজ প্রথম বছরের শেষদিন। ফাইনালে অনিরুদ্ধ জিতেছে। কিংশুকদার সঙ্গেও প্রায় দু’ঘণ্টা টিকেছিল। ছেলেটা সত্যিই দারুণ খেলে। সব সিনিয়ররা ছেড়ে চলে যাবে, তাই খেলার পর কিংশুকদা বড় করে পার্টি রেখেছিল। ভীষণ মজা করেছি আজ। সকলে মিলে জোর করে আমাকে নাচিয়ে ছেড়েছে। কিংশুকদাও খুব নাচছিল। আর বিশেষ একজনের নাচ তো দেখার মতো ছিল। কিংশুকদা-সহ বাকিরা সকলেও হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিল। আমিই বা ব্যতিক্রমী সাজব কেন? আমিও দর্শকমণ্ডলে যোগ দিয়েছিলাম।
আস্তে-আস্তে ক্লাব ফাঁকা হয়ে গেল। কেন জানি না, মনটা ভীষণ খারাপ-খারাপ লাগছিল। পার্টির পর ভেবেছিলাম, শেষ একবার মঞ্জুলার সঙ্গে কথা বলব। তা আর হল না। কিংশুকদা দায়িত্ব দিয়েছে, অল ইন্ডিয়া চেস টুর্নামেন্টের চারটে ফর্ম আমাকে মিলিয়ে দেখতে হবে সব ঠিকঠাক আছে কি না। এক সপ্তাহ বাকি আমার জীবনের প্রথম সর্বভারতীয় ম্যাচের। কাল ফর্ম জমা দিয়ে আসবে কিংশুকদা। আমি একা-একা সাদাকালো ছককাটা ঘরটার মেঝেতে বসে একমনে ফর্ম মেলাচ্ছিলাম। তখনই চেনা ডাকটা আবার কানে এল, “কী, বাংলা কথাটা জানলে?” এই মেয়েটা কি আমাকে মেরে ফেলবে? কী করে বোঝাব আমি ওকে? কী করে?
আমি ফর্মগুলো ফেলে দাঁড়িয়ে পড়েছি। মঞ্জুলা একঘর-একঘর করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ঢোক গিললাম। মঞ্জুলার সঙ্গে আজ খেলতেই হবে। জানি, হেরে যাব। বিপক্ষের কুইন তাড়া করেছে। কীভাবে রাজা বাঁচাই? কীভাবে?
মঞ্জুলা একদম আমার সামনের ঘরটায় এসে ঠোঁটটাকে আমার নাকের কাছে এনে ফিসফিস করে বলল, “তুমি কবে দাবা খেলতে শিখবে, শুনি? এখনও জানতে পারলে না?” আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি হারতে চলেছি একটা মেয়ের কাছে। তখনই খেয়াল করে দেখলাম আশপাশে কেউ নেই। বিপক্ষের কুইন পুরোপুরি সাপোর্টলেস। অনায়াসে খাওয়া যায়, এই সুযোগ! আমি একঘর এগিয়ে মঞ্জুলার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললাম, “কিস্তিমাত!”

Share This:

Post Tags:

Jyoti Sing

I'm Jyoti Sing. A full time web designer. I enjoy to make modern template. I love create blogger template and write about web design, blogger. Now I'm working with Themeforest. You can buy our templates from Themeforest.

  • To add an Emoticons Show Icons
  • To add code Use [pre]code here[/pre]
  • To add an Image Use [img]IMAGE-URL-HERE[/img]
  • To add Youtube video just paste a video link like http://www.youtube.com/watch?v=0x_gnfpL3RM