News Ticker

Menu

সংলাপ

সংলাপ

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়


দিয়াকে ঘিরে ওর বন্ধুরা সবাই সেলিব্রেট করছিল। তানিয়া, মৈনাক,  ভিকি, অদিতি, প্রজ্ঞা, সায়ক। দিয়া বুঝতে পারছিল যে, ওদের সবার মুখের সমস্ত হাসিই আসল নয়, কিন্তু ও সেটাকে পাত্তা দিচ্ছিল না, কারণ ওর মন বলছিল, লাইফের কোনও সাকসেস একা-একা এনজয় করা যায় না। তার জন্য বন্ধুদের পাশে দরকার। আর বন্ধুরা ফেল করলে যতটা দুঃখ হয়, ফার্স্ট হলে তার থেকে বেশি দুঃখ হয়, এই সরল সত্যিটা দিয়া আরও অনেকের মতোই জেনে নিয়েছে বলে, ও মাঝে-মাঝেই এর-ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা মাইন্ড-গেম খেলছিল। খেলাটা মজার। দিয়া ফেসবুক থেকে শিখেছিল একসময়। আর আজ এই কফিশপে বসে সেটা অ্যাপ্লাই করছিল, যখন যার উপর ইচ্ছে। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, তোমার আনন্দে অন্যরা ঠিক কতটা আনন্দ পেয়েছে, আঁচ করে দশের ভিতরে তাদের একটা নম্বর দেওয়া। যেমন প্রজ্ঞা যখন পরপর দু’বার প্যাকেট ছিঁড়ে চিনি মেশাতে গিয়ে কাপ থেকে কফি চলকে ফেলল, দিয়া ঝট করে ওর দু’নম্বর কেটে নিয়ে ওকে দশে চার দিয়ে দিল। ভিকির একনম্বর কাটা গেল যখন ও কথাচ্ছলে বলে উঠল যে, “সেলেব্রিটি হয়ে গেলে দিয়া আর ওদের কাউকে মনে রাখবে না।” আবার অদিতির দু’নম্বর বেড়ে গেল, যখন ও পার্সের ভিতর থেকে প্রসাদী ফুল বের করে দিয়ার কপালে ছুঁইয়ে দিয়ে বলল, তোর যাতে হয়ে যায় তার জন্য আমি ঠাকুরের কাছে পুজো দিয়েছিলাম। মৈনাকের ব্যাপারে মনস্থির করতে পারছিল না দিয়া। যখন বিকেলের ওই রোদটা ত্যারচা হয়ে ওর মুখের উপর পড়ল আর মৈনাক হাতদু’টোকে ক্যামেরার ফ্রেম করে চোখের সামনে নিয়ে এসে মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ করে বলল, “এক্সেলেন্ট, তোর ফেসটা ভীষণ ফোটোজিনিক!” তখন, মৈনাককে দশে দশ দিয়ে দিতে চাইল দিয়া।
তবে শুধু ওই কমেন্টটার জন্য নয়, এমনিই মৈনাককে ওর বেশি কিছু দিতে ইচ্ছে হয়। সেই ইচ্ছেটার নাম কি প্রেম? হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। মাসতিনেক আগে অদিতির মুখে ‘দিয়া আর মৈনাককে পাশাপাশি খুব মানায়’ শুনে, একটা তিরতিরে খুশির স্রোত  বয়ে গিয়েছিল দিয়ার মনে। কিন্তু  যৌবনে যোগিনী হয়ে একতারা নিয়ে নেচে বেড়াবে কারও পিছনে, সেই ধাতুতেও দিয়া গড়া নয়। তাই আজ মৈনাকের ওই কমপ্লিমেন্টে হাওয়ায় উড়তে-উড়তেও ও খেয়াল করতে ভুলল না যে, একটু পরেই তানিয়াকে ‘ফোটোজিনিক’ কথাটার ব্যাখ্যা দিতে দিতে মৈনাক বলছে যে, দিয়ার গালের ওই একটু রাফ ব্যাপারটাই ওকে ক্যামেরার সামনে আলাদা অ্যাডভান্টেজ দেবে। কথাগুলো অন্য কেউ বললে তখনই তার নম্বর কেটে নিত দিয়া, কিন্তু মৈনাক বলেই একটু দ্বিধায় পড়ে গেল ও। মৈনাক কি আদতে ওর প্রশংসা করছিল? না কি নিন্দে? নিন্দে হলেই বা কী এসে যায়! দিয়া তো দিয়াই। সবার চেয়ে আলাদা। আলাদা বলেই তো শৈবাল রায়ের সিনেমায় এরকম একটা চান্স পেয়েছে দিয়া।

¶ ২ ¶
অনেক লোকের দুম করে স্টার হয়ে যাওয়ার গল্প দিয়া অনেক শুনেছে। কেউ কোনও দোকানে গিয়ে চোখে পড়ে গিয়েছে কোনও পরিচালকের, তো কেউ বাস থেকে নামার সময়। দিয়ার এই গল্পগুলো ঠিক ভাল লাগত না। শুনলেই মনে হত, সাফল্য যেন ইন্সট্যান্ট কফি, যেন এমন একটা রুমাল, যা দিয়ে মুখ মুছলেই আয়নার সামনে দাঁড়ালে স্টার মনে হবে নিজেকে। আসলে দিয়া এমন একটা স্টারডম চাইত, যার জন্য নিজেকে তৈরি করতে হয়। অঙ্কে ক্লাস নাইনে একবার একশোয় পনেরো পেয়েছিল ও। ক্লাস-টিচার গার্জিয়ান কল করেছিলেন। সেদিন নিজের মায়ের ম্লান মুখটা দেখে অসম্ভব খারাপ লাগছিল দিয়ার। স্কুল থেকে ফেরার পথে ও নিচু গলায় মাকে বলেছিল, “তোমাকে আর কোনওদিন এভাবে অপমানিত হতে হবে না আমার জন্য…” আর সেই কথাটাকে সত্যি প্রমাণ করতে দিন-রাত এক করে দিয়েছিল। নাইন থেকে টেন-এ ওঠার পরীক্ষায় যখন একানব্বই পেল অঙ্কে, তখন ওই পরিশ্রমটাই সাফল্য হয়ে ফিরে এসেছিল দিয়ার কাছে। যেদিন শৈবাল রায় কনফার্ম করলেন, দিয়াই ওঁর নেক্সট ছবির সেকেন্ড হিরোইন, সেদিন? দিয়ার মনে আছে, শৈবাল ওই ‘কাম শার্প, ইটস আর্জেন্ট’ মেসেজটা ওর মোবাইলে পাঠানোর সঙ্গে-সঙ্গেই কোথায় কী যেন দুলে উঠেছিল। ও বুঝতে পেরেছিল, রেজ়াল্ট বেরনোর সময় এসে গিয়েছে। আর যখন রেজ়াল্টটা জানতে পারল,তখন, উচ্ছাসে ভেসে যাওয়ার বদলে, একটা শান্তি নেমে এসেছিল ওর মনে। মনে হয়েছিল, ও পারল। নিজের প্রতিজ্ঞা আর পরিশ্রমের জোরে আরও একটা ‘না’ কে ‘হ্যাঁ’-এ বদলে দিতে পারল। তা না হলে ও তো প্রথমদিন অডিশন দিতে গিয়েই রিজেক্ট হয়ে যাচ্ছিল। একটা সেকেন্ড কিংবা থার্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, ‘এইসব মাল চলবে না, আরও গ্ল্যামারাস চাই’ বলে ওর সামনে দিয়ে চলে গেল। কিন্তু তখনও দিয়ার ভিতরের জেদ দিয়াকে বলছিল, ‘যে চলবে, কি চলবে না, সেটা ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে দিয়াই ঠিক করবে, কোনও অ্যাসিস্ট্যান্ট নয়।’
“তুমি ওরকম অদ্ভুতভাবে কথা বলছ কেন?” ক্যামেরার লেন্স থেকে চোখ সরিয়ে শৈবাল রায় ওকে জিজ্ঞেস করলেন।
সেই প্রথম ওর সঙ্গে চোখাচুখি শৈবালের। দিয়া যখন চার লাইনের সংলাপটা বলতে ক্যামেরার সামনে যাচ্ছে, তখন ওঁর প্রায় পুরো মুখটাই ক্যামেরার পিছনে। কিন্তু ওই ভীষণ রেগে থাকা মুখটার দিকে তাকিয়েও কেঁপে যায়নি দিয়া। শান্ত গলায় বলেছিল, “আজ থেকে দেড়শো বছর আগে একটা মেয়ে তার অপরিচিত স্বামীর সঙ্গে এভাবেই কথা বলত না কি?”
“মানে?” অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর বলে উঠেছিল।
দিয়া ভ্রূক্ষেপ না করে শৈবালের চোখে চোখ রেখে বলেছিল, “আপনি তো একটা পিরিয়ড পিস বানাচ্ছেন, স্যার! ডায়ালগ বলার সময় আমি যদি সেটুকু খেয়াল না রাখি, তা হলে আমার অডিশন দেওয়ারও যোগ্যতা থাকা উচিত নয়।”
ঘরের ভিতরের লোকগুলোর থেকে আরও দু’-তিনজন কথা বলে উঠতে গিয়েছিল, কিন্তু শৈবাল একটা হাত তুলে ওদের সবাইকে থামিয়ে দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে দিয়া বুঝতে পেরেছিল, খেলাটা ঘুরছে।
খেলাটা আরও ঘুরল দিনসাতেক পরে যখন স্টুডিয়ো-লাগোয়া একটা লনে চায়ে চুমুক দিতে-দিতে শৈবাল জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কি হিস্ট্রি অনার্স?” পরিচালকের উলটোদিকের চেয়ারে বসার চান্স পেয়ে তখন দিয়া সামান্য টালমাটাল। নিজের যে ঠান্ডা মাথার উপর ওর বরাবরের ভরসা, সেই মাথাটা কেমন যেন তেতে উঠছে আর তার সঙ্গে তাতিয়ে তুলছে গোটা শরীরটাকে। তবু যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবেই ও উত্তর দিল, “না, অ্যাকাউন্টেন্সি।”
“স্ট্রেঞ্জ! কমার্সের ছাত্রী হয়েও তুমি দেড়শো বছর আগেকার মেয়েদের চালচলন নিয়ে পড়াশোনা করেছ, আই মাস্ট অ্যাপ্রিশিয়েট!”
“আমি ঠিক এগুলো করিনি, স্যার। আমি জাস্ট আপনার ফিল্মটার সম্বন্ধে কাগজে পড়েছিলাম ছ’-সাতমাস আগে। আর যখন জেনেছিলাম যে, আপনি এই ফিল্মটার সেকেন্ড হিরোইন হিসেবে একটা নতুন মেয়ে খুঁজছেন, আমার মনে হয়েছিল, আমাকে রোলটা পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে, কারণ আপনি আপনার কাজের মধ্যে দিয়ে যে ইতিহাস তৈরি করছেন, তার সঙ্গে একটু হলেও আমি জড়িয়ে থাকতে চাই। ভীষণভাবে চাই। আদারওয়াইজ়, দেড়শো বছর আগে কে কীরকমভাবে কথা বলত, জেনে, আমার কী লাভ?”
শৈবাল দৃশ্যতই গলতে শুরু করলেন। ওর সেই বিখ্যাত মেজাজ কোথায় হারিয়ে গেল। কিছুটা ফঁ্যাসফেঁসে গলায় উনি বলে উঠলেন, “কিন্তু এখানে চান্স পাওয়া, না-পাওয়ার ব্যাপারটা অনেক ইকোয়েশনের উপর ডিপেন্ড করে জান তো? পুরোটা তো আমার হাতে নেই।”
“আমার হাতে কতটুকু আছে আমি কিন্তু জানি, আর সেটা হল,আপনার ফিল্মের একটা চরিত্র হয়ে ওঠার জন্য ছ’মাস কেন, ছ’বছর লেবার দেব আমি,” দিয়া উঠে দাঁড়িয়েছিল। প্রথম শুটিংয়ের দিন দিয়ার একটাই মাত্র শট ছিল। চাইলে লাঞ্চের পরও আসতে পারত, কিন্তু সকাল ন’টা বাজতে না-বাজতেই সেটে পৌঁছে গিয়েছিল ও। শৈবাল নিজের তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও খেয়াল করলেন দিয়াকে। আর দশ মিনিটের একটা ব্রেকে ওর সামনে এসে প্রবল চিত্‌কার করে উঠলেন, “ভোর হতে না হতে স্টুডিয়োয় চলে এসেছ কেন? তোমাকে ফ্লোর ঝাঁট দিতে বলা হয়েছে?” দিয়া প্রথমটায় ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল কিন্তু সামলে নিয়ে বলল, “বললে কাল থেকে ঝাঁট দিতে পারি। আমি ওটাও শিখেছি এই রোলটার জন্য।”
শৈবাল অ্যাবাউট টার্ন করে অন্যদিকে চলে যেতে-যেতে চেঁচিয়ে উঠলেন, “ইতিহাসের অংশ হবে, ইতিহাসের অংশ হতে গিয়ে মরার আগেই ইতিহাস বানিয়ে দেবে আমাকে…”
কিন্তু এবার সেই চিত্‌কার শুনে ফ্লোরের সবাই হেসে উঠল। ভয় পেল না কেউ। লাঞ্চ-ব্রেকে শৈবাল যখন ডেকে পাঠালেন, তখন দিয়া ভাবল, কপালে বোধ হয় আবার ঝাড় আছে। কিন্তু সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়াতে শৈবাল ওর হাতে একটা ক্যান ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা একটা ফ্রেঞ্চ ফ্রুট জুস। আমার ছবির হিরোইন খায়। আমি বলে দিয়েছি, যতদিন শুটিং চলবে, তোমার জন্যেও আনাতে। প্রথমদিন বলে আমি হাতে করে দিলাম, নেক্সট দিন কোনও ঝাড়ুদারের হাত দিয়ে পাঠাব।”
দিয়া কোনও কথা বলতে পারল না, কারণ ওর গলা বুজে আসছিল। ও বুঝতে পারছিল, ওর ভিতরে একটা কিছু জন্মাচ্ছে, যাকে ঠিক প্রেম-ট্রেম বলে ডিফাইন করা যায় না। হয়তো এটাকেই ভালবাসা বলে কেউ, আর কেউ বলে, কমিটমেন্ট।
কিন্তু শৈবাল রায় কি থটরিডার? নইলে একবার ওর  দিকে তাকিয়েই কেন বললেন, “হয়তো অন্য কোনও নিউকামার তোমার থেকেও ভাল অভিনয় করতে পারত, কিন্তু তোমার কমিটমেন্ট আমি আর কোথাও পেতাম না।”
চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল বলে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল দিয়া।
শৈবাল সেদিকে তাকিয়ে বললেন, “অভিনেত্রী মুখ না তুললেও আমি তার কান্না দেখতে পাই। কাঁদতে বারণ করব না। শুধু একটা কথা মনে করিয়ে দেব, এই কান্নাটা ক্যামেরার সামনে কেঁদো। ঠিক এতটাই ন্যাচারালি। কারণ তোমার কমিটমেন্ট তোমার চরিত্রের প্রতি। কোনও ব্যক্তির প্রতি নয়।
শুটিং চলাকালীন শৈবালের কথাটা মনে পড়লে রাগ হয়ে যেত দিয়ার। কমিটমেন্টের মাঝ-বরাবর কেউ কি স্কেল দিয়ে একটা লাইন টেনে রেখেছে, যে এই এতটা পর্যন্ত গেলে চরিত্রের প্রতি থাকবে আর সেই লক্ষ্মণরেখা পেরোলেই… শৈবালকে বলতে ইচ্ছে করত দিয়ার। কিন্তু  সাহস পেত না। আসলে ততদিনে ও শৈবাল রায়কে ভালবেসে নিজের ঘটি-বাটি-আত্মা, সব মর্টগেজ দিয়ে ফেলেছে। এ এমন এক ভালবাসা, যা শুধুই স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির হতে পারে, এর কাছে ওই মৈনাক-ফৈনাক এর প্রতি হালকা হ্যাং-ওভার এত তুচ্ছ, যে তুলনাতেই আসে না। আর এই ভালবাসায় যত নিজের গলা পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছিল দিয়া, ততই বুঝতে পারছিল, শৈবালের থিওরি ভুল। ব্যক্তিকে ভালবাসলে চরিত্রের প্রতি অবিচার হয় না। কারণ, দিয়ার ফিল্মি চরিত্রটা শৈবাল ওই ক্যামেরার লেন্সের ভিতর দিয়ে নির্মাণ করছেন। এবার সৃষ্টি যদি স্রষ্টাকে ভালবাসতে না পারে, তা হলে তো মানুষ ভগবানকেও ভালবাসতে পারবে না।
দিয়া বুঝত, এসব কিছুই শৈবালের উপর কোনও ছায়া ফেলছে না। হয়তো এই সিনেমাটা শেষ হয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই দিয়াও হারিয়ে যাবে ওর পরিচালকের মন থেকে। তবু কমার্সের ছাত্রী বলেই ওর মনে হত, এত ভালবাসার উলটোপিঠে যদি ভালবাসা না থাকে তা হলে তো ডেবিট-ক্রেডিট মিলবে না! ইনডোর শুটিংয়ের শেষদিন ওই নাচের সিকোয়েন্সটা শুট হল, আর জান বাজি রাখা খাটনির দৌলতে দিয়া কোরিয়োগ্রাফির প্রত্যেকটা স্টেপ ক্যামেরার সামনে নিখুঁতভাবে তুলে ধরতে পারল, সেদিন প্যাক-আপের পর ওকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়ে গালে একটা চুমু খেলেন শৈবাল। আর কেমন একটা অন্যরকম গলায় বললেন, “তুমি  আমার ফিল্মের শরীরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছ। এই ফিল্ম যদি কিছু হয়, তা হলে তোমার জন্য হবে।”
শুনতে-শুনতে দিয়ার মনে হচ্ছিল, ডেবিট-ক্রেডিটের হিসেব মিলতে বাধ্য। কিন্তু ঠিক তখনই নক না করেই ঘরে ঢুকে পড়ল ফিল্মের প্রযোজক আর দিয়াকে চমকে দিয়ে শৈবাল বলে উঠলেন, “মিস্টার আগরওয়াল আজই ব্যাংকক থেকে ফিরে স্ট্রেট চলে এসেছেন তোমার পারফরম্যান্সের কথা শুনে। জানি তুমি টায়ার্ড, স্টিল একটা রিকোয়েস্ট করছি, ক্যামেরার সামনে যেটা করলে, সেটা এখন ওঁকে একবার দেখাও।”
মাথায় বাজ পড়লে বোধ হয় এতটা অবাক হত না দিয়া। কী বলছে ওকে শৈবাল? নিজের তৈরি করা তাজমহলের গায়ে বমি করতে? দিয়ার উত্তরের তোয়াক্কা না করে একটা স্পট-বয়কে দিয়ে ওর সকালের কস্টিউম আনিয়ে শৈবাল ক্যাজ়ুয়াল গলায় বললেন, “তুমি জাস্ট টপটা খুলে শাড়িটা জড়িয়ে নাও, মিস্টার আগরওয়াল ফিলটা পাবেন, তা হলে…”
দিয়া অনেক কষ্টে মুখ খুলল, আমি পারব না।
“বাট হোয়াই? বাংলা সিনেমার এই খারাপ বাজারে, মিস্টার আগরওয়াল আরও দু’টো ফিল্ম প্রোডিউস করবেন, উইথ মি অ্যাজ় ডিরেক্টর আর তার দু’টোতেই তুমি থাকবে, আই প্রমিস।”
“আপনার দশটা ফিল্মের হিরোইন হলেও আপনি যা করতে বলছেন, আমি করতে পারব না। ক্যামেরার প্রতি, চরিত্রের প্রতি যে কমিটমেন্টের কথা আপনি বলতেন, সেই কমিটমেন্টই  আমাকে এই নোংরামিটা করতে দেবে না।”
“কী করাবে তা হলে?” শৈবাল একটা ঠাট্টার গলায় বলেন।
“পায়ের জুতোটা হাতে নিয়ে আপনাদের দু’জনের গালে চড় দেওয়াতে পারে।”
“ইয়ে সব ক্যা হ্যায় ? ইউ কল্ড মি ফর দিস, মিস্টার রয়?” বিরক্ত আগরওয়াল বলে উঠল।
“গেট লস্ট! গেট লস্ট ফর এভার…” শৈবাল একটা বোমার মতো ফেটে পড়লেন।
কিন্তু দিয়ার কিচ্ছু মনে হল না। ভয় না,রাগ না। শৈবাল তো তখন আর স্রষ্টা নয় ওর কাছে। স্রেফ দালাল। দালালের কথা কি মনে লাগে?

¶ ৩ ¶
সেদিনের রিঅ্যাকশনটা নিয়ে দিয়া অনেকবার ভেবেছে। ভাবতে বাধ্য হয়েছে বেশি করে যখন, প্রডাকশন ইউনিট থেকে ফোন করে ওকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে আউটডোর শুটিংয়ে ওর প্রয়োজন নেই বলে, ওর প্লেনের টিকিট ক্যানসেল করে দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন নেই মানে? তা হলে যে স্ক্রিপ্ট ওকে শুনিয়েছিলেন শৈবাল রায়, তা কি পালটে গেল? জানার জন্য দিয়া ছুটে গিয়েছে স্টুডিয়োয়,
কিন্তু সেখানে তখন অন্য ফিল্মের শুটিং চলছে। ইউনিটের একে-ওকে ফোন করে ব্যাপারটা কী হচ্ছে জানার চেষ্টা করেছে দিয়া, কিন্তু অর্ধেক লোক ওর ফোন ধরেনি, বাকি অর্ধেক, ‘জানি না, ঠিক বলতে পারব না’ বলে এড়িয়ে গিয়েছে। কোথাও কোনও উত্তর না পেয়ে শেষমেশ নিজের মায়ের কাছে ভেঙে পড়েছে দিয়া। মা নিজের মেয়েকে চিনলেও, দিয়া যে এতবড় ঘটনাটা এতদিন নিজের ভিতর চেপে রাখবে, তা ভাবতে পারেননি। উনি দিয়াকে সাপোর্ট করেও বললেন যে, “ওই জুতো মারার কথাটা বলা  উচিত হয়নি। আর তার জন্য দিয়ার ক্ষমা চাওয়া উচিত শৈবাল রায়ের কাছে।”
উচিত যে হয়নি সেকথা দিয়ার নিজেরও মনে হয়েছে বহুবার। আর ক্ষমা তো পরদিন রাতেই একটা এসএমএস করে চেয়েছিল। কিন্তু একইসঙ্গে সেই মেসেজটায় ও লিখেছিল কেন ওরকম একটা কথা বলে ফেলেছিল। হঁ্যা, হিট অফ দ্য মোমেন্ট বলা ঠিকই, কিন্তু সেটাই ওর অজুহাত নয়। ইনফ্যাক্ট ওর কোনও অজুহাত ছিল না। কিন্তু একটা যুক্তি, একটা অভিমান ছিল। আর সেটা এই যে, শৈবাল রায়ের জন্যই দিয়া নিজেকে একজন, ‘শিল্পী’ হিসেবে অনুভব করেছে। এবার সেই শৈবাল যদি এমন কিছু করেন যার জন্য ওর নিজেকে একটা কলগার্ল মনে হতে থাকে, দিয়া প্রতিবাদ করবে না? না করলে যে অভিনেত্রীর পাশাপাশি ফিল্মমেকার এরও অপমান হয়! সেই মেসেজের কোনও উত্তর আসেনি। পরদিন থেকে দিয়া মেসেজ পাঠাতে পারেনি শৈবালের মোবাইলে। শৈবাল ওকে ব্লক করে দিয়েছেন দিয়া বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু অন্য কোনও নম্বর থেকে যে ফোন করবে, কী লাভ তাতে, শৈবাল তো অচেনা নম্বর দেখলে ফোন রিসিভই করেন না। হঁ্যা, ওর মায়ের নম্বর থেকে আবারও মেসেজ পাঠাতে পারত,  কিন্তু প্রথম মেসেজটায় যা ছিল, তার বাইরে অন্য কিছু তো বলার ছিল না দিয়ার।
তবু ওর মায়ের কথামতো শৈবালের সঙ্গে দেখা করার জন্য ওঁর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে শুরু করল দিয়া। সিনক্রিয়েট করা ওর বরাবরের অপছন্দ বলে, ভিতরে ঢুকে, শৈবালের ফ্ল্যাটে যাওয়ার চেষ্টা করেনি একবারও। শুধু রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে, সময়-সময় পথচলতি লুম্পেনদের টিটকিরি খেয়েও অপেক্ষা করে থেকেছে, যদি একবার দেখা হয়।
তিনদিনের মাথায় সত্যিই দেখা হল। দিয়াকে দেখতে পেয়েই হয়তো গাড়ি থেকে নেমে এলেন শৈবাল আর ওকে কথা শুরু করার চান্স না দিয়েই বললেন, “একটু ব্যস্ত আছি বলে ফোন নিতে পারছি না, কিন্তু, বিলিভ মি, ইউ হ্যাভ ডান আ গ্রেট জব। ফিল্মটা রিলিজ় করলে সবাই বলবে, আমি এখনই বলছি।”
দিয়া শুধু বলতে পারল, “থ্যাংক ইউ স্যার!”
শৈবাল গাড়িতে উঠে গিয়ে বললেন, “যারা তোমার মতো স্পষ্ট কথা বলতে পারে, থ্যাঙ্কস তো তাদের প্রাপ্য। কিন্তু সেই থ্যাঙ্কসটা কি সবসময় কথায় দিতে হবে? কথা না বলে দেওয়া যায় না?”                                    কথা আর না-কথার ভিতরে তফাতটা যে একইসঙ্গে কতটা ছোট আর বড়, দিয়া বুঝতে পারল, ফিল্মের প্রিমিয়ারে গিয়ে। যখন ওর কাছে, ইনভিটেশন কার্ড আসে, দিয়ার অসম্ভব আনন্দ হয়েছিল। মনে হয়েছিল, শৈবালের আর কোনও ‘হার্ড ফিলিংস’ নেই ওর প্রতি। প্রিমিয়ারে শৈবাল যখন ওকে দেখে একগাল হাসলেন, তখন, আরও নিশ্চিত হয়ে গেল ও। কিন্তু সিনেমাটা শুরু হওয়ার পনেরো মিনিট পর থেকেই ওর মনে হল একটন বরফ চাপিয়েও কোনও লাভ হবে না। ওর মাথার ভিতর একটা আগ্নেয়গিরি বার্স্ট করবেই করবে।
কারণ, শুধুমাত্র একটা-দু’টো সিন জুড়ে শৈবাল রায় নিজের সিনেমায় দিয়ার চরিত্রটাকে একটা বোবা মেয়েতে পালটে দিয়েছেন। এমন একটা বোবা মেয়ে, যার ধারণা যে সে কথা বলতে পারে। তাই ফিল্মে অর্ধেকের  বেশি কাঁচি হয়ে যাওয়া দিয়া যতবার পরদায় আসে ততবার, দর্শক হয় হাসে নয়তো বিরক্ত হয়, ওই একইসঙ্গে বোবা আর পাগল সেকেন্ড হিরোইনকে দেখে। যার ওই পাঁচমিনিটের নাচের দৃশ্যটাও একটা আইটেম ডান্স দিয়ে রিপ্লেস করে দেওয়া হয়েছে। সিনেমাহল থেকে কীভাবে বাড়ি ফিরেছিল দিয়ার মনে নেই। মনে নেই কীভাবে কলেজ থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল, যখন ওর চেনা-অচেনা বন্ধুরা এসে ওকে দেখাচ্ছিল, সবার মোবাইলে পৌঁছে যাওয়া সেই মেসেজটা… ‘কলেজের কত শোভা/ হিরোইন দিয়া বোবা’… মনে নেই ফ্ল্যাটের কোন ঘরে গিয়ে লুকিয়েছিল যখন ওর বাবার অফিসের পিওন একটা জরুরি চিঠি পৌঁছে দিতে এসে, ওর মা’কে বলেছিল, সামনের ক্লাবটায় ঠিকানাটা দেখাতেই সবাই বলে উঠল, “বোবার বাড়ি, বোবার বাড়ি…’
কিন্তু এইসব কিছু মনে না থাকলেও, দিয়ার সবসময় মনে ছিল, ওর বাবা ওর দাদুর থেকে পাওয়া যে ভীষণ ধারালো রেজ়ারটায় দাড়ি কামান, সেটার কথা। তাই একদিন যখন ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠল আর দিয়া ধরতেই, ওপারের গলাটা বলে উঠল, “বোবা হিরোইন’-এর সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?” দিয়া রিসিভারটা নামিয়ে রাখল আলতো করে। তারপর বাথরুমে ঢুকে হাত বাড়াল রেজ়ারটার দিকে। ঠান্ডা মাথায়।
¶ ৪ ¶
ইন্ডাস্ট্রির কেউই  ভাল বুঝতে পারল না ফ্লপ পিরিয়ড পিস রিলিজ়ের দেড়মাসের ভিতর শৈবাল রায় কীভাবে আবার নতুন ছবি তৈরির রসদ জোগাড় করে ফেললেন। এবারের ছবি, থ্রিলার আর আউটডোর হবে দার্জিলিং ও সিকিমে। শুটিংয়ের ডেট ঠিক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু লোকেশন দেখে ফেরার পথে অ্যাক্সিডেন্টটাই গুবলেট করে দিল সব। ভোরের ঘন কুয়াশায় একটা গাছে ধাক্কা মেরে ঢাল বেয়ে অনেকটা চলে যায় এসইউভি। স্থানীয় একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাথায় আটটা স্টিচ হয় শৈবাল রায়ের। রাতে কলকাতায় ফিরেই একটা হাই-ফাই প্রাইভেট হসপিটালে ভর্তি হয়ে শৈবাল জানতে পারেন যে প্রচুর ব্লাড-লস হয়েছে বলে ওঁকে রক্ত নিতে হবে। উনি ওই অবস্থাতেই মিডিয়াতে ওঁর বন্ধুদের ব্যাপারটা জানিয়ে একটা স্টোরি করতে অনুরোধ করেন আর এক্সক্লুসিভ কেবিনে শুয়ে স্যালাইন-স্ট্যান্ড থেকে ঝোলা রক্তের বোতলটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকেন এই ঘটনাটা কাগজে বেরোলে যে সিমপ্যাথি পাবেন, তা পরের ছবিটাকে হিট করাবেই…
ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটে।
কেবিনের সিলিংয়ে রক্তের অক্ষরে ফুটে ওঠে, “এই ছবিটাতেও কি কোনও বোবা মেয়ে থাকছে?” কড়া ঘুমের ওষুধ কাজ শুরু করার আগেই যেন থেমে যায়। শৈবাল নার্সকে ডাকতে গিয়ে দেখেন গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। কোনওমতে বলে ওঠেন, “কে তুমি? কী চাও?” সিলিংয়ে রক্তের অক্ষরে আবার ফুটে ওঠে, “কথা বলতে চাই।আমার সঙ্গে কথা বলবে?” শৈবাল এবার প্রাণপণে হাত বাড়িয়ে বেডসাইড বেলটা বাজাতে চান কিন্তু আঙুল বেল ছোঁয়ার আগেই প্রবল শব্দ করে  রক্তের বোতলটা ফাটে। আর তার একখণ্ড কাচ সোজা এসে ওঁর গলায় বিঁধে যায়।
দীর্ঘ অপারেশনের শেষে ক্লান্ত ডক্টর সেন বললেন, “ডিরেক্টর রায় প্রাণে বেঁচে যাবেন কিন্তু ওর ভোকাল কর্ড এমন বিশ্রীভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে যে, একটা মারাত্মক ক্ষতি হয়েই গেল। জীবনে উনি আর কথা বলতে পারবেন না। ডক্টর ঘোষ বললেন, “এভাবে বোতল ফেটে গলায় কাচ ঢুকে যাওয়ার ইনসিডেন্ট আমি আমার ডাক্তারি লাইফে কখনও দেখিনি। ঘটল কী করে?”
কীভাবে ঘটল, সেই কৈফিয়ত কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে বলে ফ্লোর ম্যানেজার সুজাতা নাওয়া-খাওয়া ভুলে অনুসন্ধান চালাল তিনদিন। কিন্তু একটা ছবি ছাড়া ওই ঘর থেকে আর কিছুই পাওয়া গেল না যা ধরে তদন্ত এগোনো যেতে পারে। ছবিটা একটা অল্পবয়সি মিষ্টি মেয়ের যে খুব হেসে-হেসে কথা বলছে। মেয়েটাকে কেমন যেন চেনা লাগল সুজাতার। তিনদিন পর টিভিতে একটা অ্যাওয়ার্ড ফাংশন দেখার সময় মেয়েটাকে আবার দেখতে পেল সুজাতা। দিয়া বসু। এ’বছরের সবচেয়ে প্রমিসিং নিউকামার যে একটা বোবা মেয়ের চরিত্রে তাক লাগানো অভিনয় করেছে। স্যাডলি, ফিল্মটা রিলিজ় করার কয়েকদিনের মধ্যেই অজানা কোনও কারণে দিয়া সুইসাইড করে। তাই, ওর বাবা-মা কিংবা কোনও রিলেটিভের হাতে প্রাইজ়টা তুলে দেওয়া হবে। সুজাতা দেখল, ঘোষক আবারও বলছেন, “দিয়ার হয়ে প্রাইজ় নেওয়ার জন্য কেউ থাকলে,এগিয়ে আসবেন প্লিজ়…”

Share This:

Post Tags:

Jyoti Sing

I'm Jyoti Sing. A full time web designer. I enjoy to make modern template. I love create blogger template and write about web design, blogger. Now I'm working with Themeforest. You can buy our templates from Themeforest.

  • To add an Emoticons Show Icons
  • To add code Use [pre]code here[/pre]
  • To add an Image Use [img]IMAGE-URL-HERE[/img]
  • To add Youtube video just paste a video link like http://www.youtube.com/watch?v=0x_gnfpL3RM